রাজনৈতিক দলগুলি একজোট। রাজি স্থানীয় বাসিন্দারাও। জমিরক্ষার আন্দোলনে উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা পড়াই যখন রাজ্যে চেনা ছক হয়ে উঠেছে, তখন বর্ধমানের কাটোয়ায় এনটিপিসি-র প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুরোদস্তুর উলটপুরাণ! যে ঘটনা বুঝিয়ে দিল, নেতির রাজনীতিতে আমজনতার আর আস্থা নেই। উন্নয়নই যে সুদিন আনবে, সেটা ক্রমে বুঝতে পারছেন তাঁরা।
বদল আসছে সরকারের অবস্থানেও। এই প্রকল্পের জন্য বাম আমলে প্রায় সাড়ে পাঁচশো একর জমি অধিগৃহীত হয়েছিল। এখনও দরকার অন্তত ২২০ একর। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সরকার কারও থেকে এক ছটাক জমিও নেবে না। ফলে কাজ আটকে যায়। চাপে পড়ে নিজেরা জমি কিনতে নেমেও সরকারি সাহায্য না পেয়ে প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থাটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে এগিয়ে এসেছে রাজ্য। মঙ্গলবার কাটোয়া মহকুমা প্রশাসনের উদ্যোগে ডাকা সর্বদল বৈঠকে রাজ্যের চার প্রধান দলই জানিয়ে দিল, প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমি কেনার জন্য তারা এনটিপিসি-কে সর্বতো ভাবে সাহায্য করবে।
শুধু তা-ই নয়, অজয় নদের কোল ঘেঁষা সাহাপুর মৌজার যতীনপুর ও আঙারপুর গ্রামের চাষিরা নিজের থেকেই প্রায় দু’শো একর জমি বিক্রি করতে চেয়েছেন এনটিপিসি-কে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলিকে চিঠিও দিয়েছেন তাঁরা। এ দিন সর্বদল বৈঠকের মাঝে এক চাষি ঢুকে পড়ে একই অনুরোধ করেন কাটোয়ার মহকুমাশাসককে। ঘটনা হল, এই দুই গ্রামের জমি নেওয়ার কোনও পরিকল্পনা এনটিপিসি-র এখনও নেই। কিন্তু জমি বেচার উৎসাহ দেখে রীতিমতো অবাক সংস্থার অতিরিক্ত জেনারেল ম্যানেজার শিবাশিস বসু বলেন, “ওই দুই গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি আমরা নজরে রাখছি।” আর কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের প্রতিক্রিয়া, “এ ভাবে দু’টো গ্রাম জমি বেচার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, আগে শুনিনি!”
সরকার এবং আমজনতার মনোভাবের এই পরিবর্তন কেন?
ওয়াকিবহাল অনেকেরই মতে, বাস্তব পরিস্থিতি থেকে খানিকটা হলেও শিক্ষা নিয়েছে দু’পক্ষই। বিরোধী দল থাকাকালীন তৃণমূলের আন্দোলনে সিঙ্গুর থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল টাটাদের। তার জেরে সিঙ্গুরের এখন যা অবস্থা হয়েছে, সেটা সকলেরই জানা। সব থেকে দুরবস্থা চেক না-নেওয়া চাষিদের। কর্মসংস্থানের আশায় যাঁরা জমি দিয়েছিলেন, ভেঙে পড়েছেন তাঁরাও। ফলে প্রকল্প না হলে আখেরে যে রাজ্যেরই ক্ষতি, সেই বোধ ধীরে হলেও ক্রমে জাগছে বলেই অনেকের মত। তাঁদের বক্তব্য, এই বোধ থেকেই যতীনপুর ও আঙারপুরের গ্রামবাসীরা এখন স্ব-ইচ্ছায় প্রকল্পের জন্য জমি দিতে চাইছেন। অথচ একটা সময় তাদের পাশের দুই গ্রাম চুড়পুনি ও কোশিগ্রামে জমি নিতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়েছে জেলার ভূমি অধিগ্রহণ দফতরকে। বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গির জেরেই রাজ্য সরকারও জমি নেওয়ার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে এগিয়ে এসেছে বলে মনে করছে শিল্প মহলের একাংশ।
এ দিন বেলা ৩টে নাগাদ কাটোয়া মহকুমাশাসকের দফতরে এনটিপিসি কর্তা, নানা রাজনৈতিক দল, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কর্মীদের নিয়ে আলোচনায় বসে প্রশাসন। কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এনটিপিসি কর্তৃপক্ষকে বলেন, “দু’টি নয়, আপনারা চারটি ইউনিট গড়ুন। জমি জোগাড় করার ব্যাপারে আমরা সঙ্গে আছি।” সঙ্গে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন শেখ সাহানেওয়াজও। প্রকল্প এলাকাটি তাঁর কেতুগ্রাম বিধানসভার মধ্যেই পড়ে। তিনি বলেন, এলাকার চাষিরা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমি দিতে ইচ্ছুক। চাষিরা যাতে সঠিক দাম পান, সেটা এনটিপিসিকেই দেখতে হবে। রবীন্দ্রনাথবাবুও বলেন, আগের তুলনায় জমির দাম বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বর্গাদার, খেতমজুররা যাতে ভাল প্যাকেজ পান সেটাও এনটিপিসিকে দেখতে হবে। বিজেপির অনিল দত্ত ও সিপিএমের কমল ঠাকুররাও এই প্রকল্পের জন্য সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এ দিনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাকি যে ২২০ একর জমি দরকার, রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের (পিডিসিএল) পূর্বনির্ধারিত দর মেনেই কেনা হবে। কাটোয়ায় প্রকল্প গড়তে গোড়ায় এগিয়ে এসেছিল রাজ্য সরকারি সংস্থা পিডিসিএল-ই। এ দিন এনটিপিসি-র পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়, ২০০৮ সালে মহকুমা শাসকের দফতরে একটি সর্বদলীয় বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে জমির দাম নির্ধারিত হয়েছিল। সেই দাম অনুযায়ী ২০১০ সালে কোশিগ্রাম মৌজার চাষিরা একর পিছু দাম পেয়েছিলেন সাড়ে ১১ লক্ষ টাকার উপর।
যদিও পিডিসিএলের দরে জমি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জমিদাতাদের একাংশের মধ্যে এখনও বিভ্রান্তি রয়েছে। এ দিনের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানার পরে বিভিন্ন গ্রামে বিচ্ছিন্ন ভাবে বৈঠক হয়। সেখানে দর নিয়ে নানা রকম দাবি ওঠে। অনেকে বেশি দর চাইবেন কি না, তাতে এনটিপিসি পিছিয়ে যেতে পারে কি না, সেটা নিয়েও জল্পনা চলে। চাষিদের একাংশ আবার মনে করছেন, বেশি দরাদরি না করে নিয়ম মেনে স্থির হওয়া দরেই জমি দেওয়া ভাল। তবে রাত পর্যন্ত এ নিয়ে প্রায় কেউই মনস্থির করতে পারেননি।
যাঁরা জমি দেবেন বলে ইতিমধ্যে ইচ্ছাপত্র দিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম উজ্জ্বল গুপ্ত, আবু তালেব, মুজিবর রহমান, ওসমান গনিদের বক্তব্য, “আমরা জমি দেব বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। এনটিপিসি মুখোমুখি বসে আমাদের সঙ্গে দাম ঠিক করুক। ন্যায্য দাম পেলেই জমি দেব।” ইতিমধ্যেই জমি দিয়েছেন নাজমুল হুদা, প্রশান্ত ঘোষ, নারায়ণ চন্দ্ররা। তাঁরা বলেন, “আমরা চাই, তাড়াতাড়ি প্রকল্প গড়ে উঠুক। যাতে এলাকার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান তৈরি হয়।”
এই উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ভাবনা থেকেই না-চাইতেই তিন ফসলি জমি এনটিপিসি-কে দিতে চান যতীনপুর ও আঙারপুরের বাসিন্দারা। দুই গ্রামে প্রায় ১০০ শতাংশ বাসিন্দাই কৃষিজীবী। আঙারপুরের সহদেব ঘোষ, নিত্যানন্দ পাল বা যতীনপুরের প্রভাতকুমার পাল, পুলক ঘোষেরা বলছেন, পরিবার পিছু জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই চাষ করে লাভের অঙ্ক কমছে। দ্বিতীয়ত, শারীরিক ভাবে যাঁরা সক্ষম, তাঁরা গায়ে খেটে চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন। কিন্তু যাঁরা শ্রমিক বা যন্ত্র ব্যবহার করে ছোট জমিতে চাষ করাচ্ছেন, তাঁরা নানা খাতে খরচা করে ফেলায় লাভের মুখ দেখছেন না। এই পরিস্থিতিতে জমি রেখে লাভ কী? চাষ করে লাভ হয় না বলে এই দুই গ্রামের প্রায় ৭০ শতাংশ যুবক সুরাত, দিল্লি-সহ বিভিন্ন জায়গায় গয়না-শিল্পে কাজ করতে গিয়েছেন। যতীনপুর গ্রামের যুবক বিশ্বপ্রকাশ পালের কথায়, “এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে আমাদের আশা, ‘কপোর্রেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি স্কিম’-এ এলাকার অনেককেই বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেবে এনটিপিসি। চাকরি পেতে সুবিধা হবে। তাই আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি দিতে চাই।”
কাটোয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল বাম আমলে। ২০০৫-এর অগস্টে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হলে চাষিরা আন্দোলনে নামেন। ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটের আগে মাত্র ৯.৯১ একর জমি অধিগ্রহণের পরে প্রকল্পের শিলান্যাস করা হয়। এর পর বাম সরকার ভাল প্যাকেজ ঘোষণা করার পরে চাষিরা জমি দিতে রাজি হন। ৫৫৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু ২০১০-এর পর থেকে আর জমি অধিগ্রহণ হয়নি।
প্রকল্প গড়ার পথে জমি যাতে আর কোনও বাধা না হয়, সে জন্য পথে নেমে চাষিদের বোঝাবেন বলে এ দিন আশ্বাস দিয়েছেন চার দলের নেতারাই।