কোরপান খুন

কোণঠাসা হয়েই কি ঘুম ভাঙল কমিশনের

হঠাৎ কী এমন হল যে নড়েচড়ে বসতে হল রাজ্য মানবাধিকার কমিশনকে! কী-ই বা এমন ঘটল, যে কোরপান শা খুনে কলকাতা পুলিশের কাছে রিপোর্টের জবাব না পেয়ে ফের তৎপর হল তারা! গত ১৬ নভেম্বর এনআরএস হাসপাতালে গণপিটুনিতে মারা যান মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক কোরপান শা। নভেম্বরের শেষে কলকাতা পুলিশের কাছে এক বার এই নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০০
Share:

হঠাৎ কী এমন হল যে নড়েচড়ে বসতে হল রাজ্য মানবাধিকার কমিশনকে! কী-ই বা এমন ঘটল, যে কোরপান শা খুনে কলকাতা পুলিশের কাছে রিপোর্টের জবাব না পেয়ে ফের তৎপর হল তারা!

Advertisement

গত ১৬ নভেম্বর এনআরএস হাসপাতালে গণপিটুনিতে মারা যান মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক কোরপান শা। নভেম্বরের শেষে কলকাতা পুলিশের কাছে এক বার এই নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু যথাসময়ে রিপোর্ট না আসায় ধামাচাপা পড়ে যায় গোটা বিষয়টা। গত ২৭ ডিসেম্বর পুলিশের কাছে রিপোর্ট চেয়ে ফের তাগাদা দিয়েছে কমিশন।

রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে বসানোর পর থেকেই কমিশন পঙ্গু হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠছিল বারেবারে। বিশেষ করে পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা কোনও অভিযোগের তদন্ত প্রাক্তন ডিজি-র নেতৃত্বাধীন ওই কমিশন করবে কি না, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়। সম্প্রতি বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বিচারপ্রার্থীরা তাই দিল্লিতে গিয়ে সরাসরি অভিযোগ জানিয়ে এসেছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে। কোরপান শা-র পরিবারও ছিল সেই দলে।

Advertisement

রাজ্য কমিশন এক বার তদন্ত রিপোর্ট চেয়ে পাঠানোর পর তা নিয়ে বিশেষ গা করেনি কোনও পক্ষই। লালবাজারের একটি সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য মানবাধিকার কমিশন যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোরপান শা খুনে তদন্তের রিপোর্ট চাইবে, এমনটা ভাবতে পারেননি কেউই। তাই কমিশনের চিঠির অস্তিত্ব ধরা পড়ে বেশ কিছু দিন দেরিতে। যদিও তার পরেও চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি লালবাজার। বিষয়টি কোর্টের বিচারাধান হওয়ায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের পক্ষে এখন তদন্তে যাওয়া যে সম্ভব নয়, তা বুঝেই পুলিশ কোনও উত্তর দেয়নি বলে দাবি লালবাজারেরই একটি সূত্রের।

রাজ্য মানবাধিকার কমিশন নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠল কেন? নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রথম বার রিপোর্ট তলব করার পর কোরপান শা-র পরিবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থ হওয়াতেই কী চাপ বাড়ে তাদের উপর? নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণও রয়েছে?

কমিশন সূত্রের খবর, গত ১০ ডিসেম্বর শিশির মঞ্চে মানবাধিকার দিবসের অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর বক্তব্যও এর পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছে। কমিশন যে ভাবে চলছে সেটা যে তাঁর মনঃপূত নয় এমন ইঙ্গিত দিয়ে সে দিন রাজ্যপাল বলেন, “দেখতে হবে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের উপর মানুষের আস্থা যেন কমে না যায়।” আস্থা ফেরানোর উপায়ও বাতলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “রাজ্য সরকার দ্রুত কমিশনের এক জন স্থায়ী চেয়ারম্যান নিয়োগ করুক।”

মানবাধিকার কমিশনের একটি সূত্রের দাবি, এর পরই সতর্ক হয়ে পড়েন নপরাজিতবাবু। কমিশনের সদস্য হিসাবে তাঁর মেয়াদ রয়েছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে অন্য কেউ তাঁর মাথায় স্থায়ী চেয়ারম্যান হয়ে বসুন, তা চাইছেন না তিনি। ফলে তিনি যথেষ্ঠ যোগ্য এবং পুলিশের বিরুদ্ধে কড়া হতেও পিছপা নন এমন একটা ভাবমূর্তি তৈরি করতে আপাতত মরিয়া অস্থায়ী চেয়ারম্যান। তাঁর আমলে কবে, কোন কোন ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, পরিচিত মহলে ইদানীং তা ফলাও করে বলতে শুরু করেছেন তিনি। তবে, কমিশনের একাংশের মতে, রাজ্যপালের মন্তব্যের আগেই কোরপানের ঘটনায় রিপোর্ট তলব করা হয়েছিল। তাই সবটাই রাজ্যপালের জন্য হয়েছে এটা ভাবা ঠিক নয়।

তাঁর আমলে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে, এমন অভিযোগ মোটেই মানতে রাজি নন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। নপরাজিতবাবু জানিয়েছেন, “লোকে কী বলল তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার কাজ আমি করি। রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা আমি কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে বলেছি। আজ নয় তো কাল ওঁদের রিপোর্ট দিতেই হবে। আর তাতেও না হলে ওঁদের কমিশনে হাজির হতে বলা হবে।”

কলকাতা পুলিশ তা হলে কেন কমিশনের চিঠির জবাব দিল না? সিপি সুরজিৎ করপুরকায়স্থ জানিয়েছেন, “ওরা রিপোর্ট চেয়েছিল। বিষয়টি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সুধীর মিশ্র দেখছেন। ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন।” সুধীর মিশ্র প্রথমে বিষয়টি মনেই করতে পারেননি। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, “অনেক দিন আগের বিষয়। ফাইল ঘাঁটতে হবে। পুলিশ তো আলাদা তদন্ত করছে। সম্ভবত তদন্ত কিছুটা এগোলে সেই সব তথ্য-সহ রিপোর্ট পেশ করা হবে।”

তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কমিশনের উপর থেকে সকলে আস্থা হারাচ্ছে বলেই কি লালবাজার তাঁর চিঠির জবাব দিল না? জানতে চাওয়া হলে নপরাজিতবাবুর মন্তব্য, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এ রকম একটা ধারণা ছড়ানো হচ্ছে। গত এক বছরে একাধিক ঘটনায় আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত করে রাজ্য সরকারকে সুপারিশ করেছি। অনেক পুলিশকর্মীকে কমিশনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকাও হয়েছে। এই তো সে দিন হাওড়ায় এক মহিলাকে নিগ্রহের ঘটনায় আমরা অভিযুক্ত অফিসারের শাস্তির প্রস্তাব দিয়েছি।”

কোরপান-কাণ্ডে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন ঘটনার পর-পরই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্তের নির্দেশ দিল না কেন? নপরাজিতবাবুর কথায়, “কোরপান শা-র পরিবার কেন কমিশনে এলেন না জানি না। তাঁদের আসার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। তাঁরা সরাসরি এলে আমরা তদন্ত করে নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করতে পারতাম। কিন্তু কোরপানের পরিবার সরাসরি হাইকোর্টে চলে গেলেন। এখন তো আমরা আর তদন্ত করতে পারব না।”

রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “অভিযুক্তরা সরাসরি আদালতে গিয়েছেন। ফলে মানবাধিকার কমিশন এখন রিপোর্ট চাইল কী চাইল না, তা গুরুত্ব হারিয়েছে। পুলিশ সেটা জানে। তাই তারাও মাথা ঘামাচ্ছে না। কমিশনে আদৌ রিপোর্ট জমা দেবে কিনা, তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।” অশোকবাবুর কথায়, “কমিশন এ নিয়ে সত্যিই কিছু করতে চাইলে ঘটনার পর-পরই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারত। কারণ, তখনও বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।”

কোরপানের ভাই রওশনের বক্তব্য, “রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে আমাদের আস্থা নেই। ওরা সরকারের হাতের পুতুল। কিচ্ছু করবে না। আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন জানিয়েছি।”

তবে রাজ্যের মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের এ হেন পদক্ষেপে বিস্মিত। তাঁদেরই এক জনের মন্তব্য, “অবেশেষে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল বলে মনে হচ্ছে। দেরিতে হলেও এটা মন্দের ভাল।”

ধৃত দুইয়ের জেল হেফাজত

এনআরএস ছাত্রাবাসে কোরপান শাহকে খুনের ঘটনায় ধৃত দুই ক্যান্টিনকর্মীকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিল আদালত। কার্তিক মণ্ডল ও রুবি আন্দিয়া নামে ওই দুই ক্যান্টিনকর্মী ২৭ ডিসেম্বর থেকে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। শনিবার তাঁদের শিয়ালদহ আদালতে ভারপ্রাপ্ত এসিজেএম অর্পিতা হীরার এজলাসে হাজির করা হয়। সরকারি আইনজীবী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় ধৃতদের জেল হেফাজতে পাঠানোর আর্জি জানান। অভিযুক্তদের আইনজীবী পার্থ দাস কোনও সওয়াল করেননি। দু’পক্ষের সওয়াল শোনার পর দুই অভিযুক্তকে ১৪ দিনের জন্য জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। পার্থবাবু জানান, ধৃতদের জামিনের জন্য হাইকোর্টে আর্জি জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন