কোন স্যরের কোন দিন ক্লাস আছে, মাথায় রেখে কলেজ যাওয়ার অভ্যাস আছে ছাত্র-ছাত্রীদের। এ বার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেও চালু হচ্ছে তেমন রুটিন সংস্কৃতি!
নেতা মানে শুধু বক্তৃতা করে বেড়ানো নয়! নানা জায়গা থেকে আসা দলের নেতা-কর্মীদের কথা শোনাও রাজ্য নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। তাই দলের রাজ্য নেতাদের জন্য আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সদর দফতরে আবশ্যিক উপস্থিতির নির্ঘণ্ট বেঁধে দিল সিপিএম। এখন থেকে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে রাজ্য পার্টি কেন্দ্রে হাজির থাকবেন। শহর বা জেলা থেকে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা যে ফরিয়াদ নিয়ে আসবেন, দফতরে বসে সংশ্লিষ্ট নেতাদের তা শুনতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য নোট রাখতে হবে।
দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই সূর্যকান্ত মিশ্র সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে যে সব জেলার নেতারা আছেন, তাঁদের কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেই ব্যবস্থা থেকেই এ বার আরও এক ধাপ এগিয়েছে আলিমুদ্দিন। শুধু কলকাতায় থাকার আস্তানাই নয়, দলের রাজ্য দফতরে নির্দিষ্ট দিনে হাজিরা দেওয়ার ফরমান জারি হয়েছে দলের তরফে। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদ্যসমাপ্ত বৈঠকে পেশ হওয়া রিপোর্টে কোন নেতা কোন দিন আলিমুদ্দিনে উপস্থিত থাকবেন, তার রীতিমতো তালিকা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের জন্যই। কিন্তু একই সঙ্গে রিপোর্টে আহ্বান জানানো হয়েছে, রাজ্য কমিটির যে সব সদস্য রাজ্য পার্টি কেন্দ্রের তরফে অন্য জেলা বা গণসংগঠনের কাজে যুক্ত, তাঁরাও সম্ভব হলে সপ্তাহে এক দিন আলিমুদ্দিনে বসুন।
দল ক্ষমতায় থাকাকালীন উপর তলার নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মীদের যোগাযোগের অভাব নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে সিপিএমে। বিভিন্ন সম্মেলনে বা কমিটির বৈঠকে দলের অনেকেই সরব হয়েছেন, নিচু তলার কর্মীদের কথা নেতাদের কান পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। ফলে, দলও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারিয়ে বিরোধী ভূমিকায় যাওয়ার পরে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে দলের অন্যান্য স্তরের সেতুবন্ধনে বিশেষ উদ্যোগী হল আলিমুদ্দিন। এমনিতেই রাজ্য পার্টি কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কিছু সদস্য নিয়মিতই রাজ্য দফতরে যান। কিন্তু রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সব সদস্যের জন্য উপস্থিতির নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দিয়ে গোটা ব্যবস্থার মধ্যে এ বার নতুন অনুশাসন আমদানির চেষ্টা হল।
বস্তুত, ঠেকে শিখে সিপিএম নেতৃত্বের এখন উপলব্ধি হচ্ছে, শুধু তত্ত্বকথায় বা গুরুগম্ভীর প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের মন পাওয়া সম্ভব নয়। নিচু তলার কমিটিগুলিকেও ওই পথে বিশেষ সক্রিয় করা সম্ভব নয়। এ বারের রাজ্য কমিটির রিপোর্টেই যেমন বলা হয়েছে: ‘ভোটার তালিকা সংশোধন, ডিজিটালাইজড রেশন কার্ড ও আধার কার্ড করানো থেকে শুরু করে এলাকার মানুষের যে কোনও সমস্যায় তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর দৈনন্দিন কাজের মধ্যে দিয়েই কমিটিগুলিকে কর্মতৎপর করা যাবে। কেবল এগুলিই পারে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রামকে প্রসারিত করতে এবং সর্বোপরি রাজ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন করতে’। এই সব কাজের সমন্বয় মসৃণ করার জন্যই দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কর্মতৎপরতা বাড়াতে বলা হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘বিধানসভায় যেমন বিভিন্ন মন্ত্রীর উপস্থিতির নির্দিষ্ট দিন ঠিক করা থাকে, এটাও অনেকটা সেই রকম। আমাদের সাংসদেরাও সপ্তাহে ছুটির দিন নিজেদের এলাকায় নির্দিষ্ট দফতরে বসেন নানা দাবি ও অভিযোগ শোনার জন্য। রাজ্য কেন্দ্রেও এ বার থেকে নির্দিষ্ট সূচি মেনে রাজ্য নেতাদের উপস্থিত থাকতে হবে।’’
সপ্তাহে কোন দিন কোন নেতা সকালে ও কে বিকালে থাকবেন, সবই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে রাজ্য কমিটির তালিকায়। রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবুর যেমন নিজের উপস্থিত থাকার দিন পড়েছে বুধ ও বৃহস্পতিবার। পুরসভার মেয়র হিসাবে শিলিগুড়িতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় বলে অশোক ভট্টাচার্যকে আলিমুদ্দিনে পাওয়া যাবে শুধু বুধবার। ওই দিন সচরাচর দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক থাকে। ফলে অশোকবাবুকে আলাদা করে কলকাতা আসতে হবে না। বিমান বসুর জন্যও মঙ্গলবার দিন ধার্য করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বলে দেওয়া হয়েছে, বিমানবাবু যে হেতু আলিমুদ্দিনেরই বাসিন্দা, তাই কলকাতার বাইরে কর্মসূচি না থাকলে অন্য দিনও তাঁকে পাওয়া যাবে। পলিটব্যুরোর আর এক সদস্য মহম্মদ সেলিম সংসদের অধিবেশন না থাকলে মঙ্গল ও বুধবার রাজ্য দফতরে থাকবেন।
এই তালিকায় নেই শুধু এক জন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! শরীর সুস্থ থাকলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রোজই দু’বেলা করে দফতরে আসেন। তাই ‘বুদ্ধস্যর’কে প্রায় ক্লাস টিচার বলা যেতে পারে! তাঁর জন্য কোনও বিশেষ দিন নেই।