মিছিলের দামামা যত জোরে বাজছে, মিছিল নিয়ে প্রশ্নের সুরও ততই চড়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক অতীতে এ রাজ্যে বারবার প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। কিন্তু এ বারে লেখক-শিল্পী-অভিনেতাদের প্রতিবাদে তিনি গলা মেলাচ্ছেন না। আজ, শুক্রবার নন্দন থেকে জমায়েত প্রসঙ্গে শঙ্খবাবুর সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, “প্রতিবাদকারীরা কি জানেন, কীসের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ?’’
সারদায় ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী গর্জে ওঠার পরেই শুরু হয়েছে সংস্কৃতিজগতকে পথে নামানোর তোড়জোড়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই মঞ্চ থেকে তাঁর অনুগতদের এই নির্দেশ দিয়েছেন। মমতার সমাবেশে প্রতিবাদীদের অনেকের বুকে ‘আমরা সবাই চোর’ লেখা প্ল্যাকার্ডও দেখা গিয়েছিল। এর পরে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি চুরির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা দিতেই লেখক-শিল্পীরা পথে নামবেন?
অপ্রিয় প্রশ্ন ধামাচাপা দিতে চেষ্টার অবশ্য কসুর করছেন না মুখ্যমন্ত্রীর অনুগতরা। মিছিল ম্যানেজমেন্ট-এর তিন কর্তা টলিউডি প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা, অভিনেতা অরিন্দম শীল ও কবি সুবোধ সরকার। বৃহস্পতিবার দিনভর তিন জনই ছিলেন সক্রিয়। মিছিল সফল করতে তাঁদের সঙ্গে কোমর বেঁধেছেন, গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী, গায়ক ইন্দ্রনীল সেনও। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির ঘনিষ্ঠ এক নেতার কাছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ফোন গিয়েছে। তাঁর নির্দেশ, মিছিল যেন অতি অবশ্যই হাউসফুল হয়।
এই মিছিল যে আদতে কোনও দুষ্কর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে নয়, তা বোঝাতে সুবোধ বিস্তর শব্দ খরচ করেছেন এ দিন। তাঁর দাবি, “এ মিছিল আদতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদ। কিছু টিভি চ্যানেলে দিনভর বাংলার বিষয়ে নেতিবাচক প্রচার চালানো হয়। লোকে ভাবে, পশ্চিমবঙ্গে কি তবে শুধু চুরিই হয়! প্রতিবাদটা এর বিরুদ্ধেই।” মিছিলের আমন্ত্রণী এসএমএসে ‘সংস্কৃতির উপরে আঘাতে’র কথা শুনে যিনি ধন্দে পড়েছিলেন, মমতা-ঘনিষ্ঠ অভিনেতা সেই রুদ্রনীল ঘোষও এ দিন সুর পাল্টেছেন। অবশেষে মিছিলের গুরুত্ব বুঝেছেন। রুদ্রর কথায়, “আমরা বন্ধুরা রাজ, বিরসারা (পরিচালক রাজ চক্রবর্তী ও বিরসা দাশগুপ্ত) মিলে কথা বলে ঠিক করেছি, মিছিলে যাব।” কেন যাবেন? “পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। তার প্রতিবাদ করব।” দার্জিলিংয়ে আউটডোর থাকায় রাজের উপস্থিতি নিয়ে সংশয় ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি মিছিলে থাকছেন বলেই জানা গিয়েছে।
তবে আয়োজকদের এ দিন রাত পর্যন্ত জনে-জনে বোঝাতে হয়েছে, এ মিছিল কীসের পক্ষে এবং কীসের বিরুদ্ধে? মমতা ইদানীং কালে চক্রান্তের অভিযোগে কখনও সিবিআই, কখনওসংবাদমাধ্যম, কখনও গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কে আক্রমণ করে বসেছেন। অনেকটা ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর ভঙ্গিতে সুবোধ এ দিন বলেছেন, “না, না আমরা র-এর বিরুদ্ধে না। সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বা সিবিআইয়ের বিরুদ্ধেও না। এ হল, বাংলার পক্ষে হাঁটা।”
যদিও আমন্ত্রিতদের অনেকের কাছেই বিষয়টা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যাবৎ বিভিন্ন দাবিতে যাঁরা মমতার সঙ্গে প্রতিবাদে শরিক হয়েছেন, তেমন অনেকেরই এই মিছিল নিয়ে বিতৃষ্ণা রয়েছে। অনেকেই মিছিলে যোগ দেওয়ার অনুরোধ সরাসরি ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে মমতা-ঘনিষ্ঠ শিল্পীদের সূত্রেই জানা গিয়েছে। আবার অনেকে সরাসরি কিছু না বললেও বিতৃষ্ণা গোপন করতে পারেননি।
নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর কথায়, “যাঁরা আমায় প্রশ্ন করছেন, তাঁদের জানা উচিত, আমি কোথায় যাই আর যাই না! আর কিছু বলব না।” আর এক প্রবীণ মনোজ মিত্রর কথায়, “মিছিল-টিছিল ঢের হয়েছে। আমি গেলে দেখতে পাবেন, না গেলেও দেখা যাবে--- এর বেশি কিছু বলার নেই।”
বিরোধী শিবির প্রত্যাশিত ভাবেই এমন মিছিল নিয়ে সরব। বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের আবেদন, “যে বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি এখনও জীবিত আছে, তাঁরা ভেবে দেখুন, ওই মিছিলে যাবেন কি না। এর পর তো ডাকাত, ধর্ষক, খুনিরাও ডাকাতি, ধর্ষণ এবং খুনের অধিকারের দাবিতে মিছিল করবে!” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর টীপ্পনী, “মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, তৃণজীবীরা মিছিল করবেন। বেঁচে থাকার স্বার্থে যাঁরা তৃণমূলের উপরে নির্ভরশীল। তাঁরা তো তৃণজীবীই!”