বহরমপুর

কতটা পথ পেরোলে তবে...

‘কে ইন্দ্রনীল সেন? তিনি তো বহিরাগত! কত দিন তৃণমূল করছেন? উড়ে এসে জুড়ে বসলেন? এখানকার কেউ কি প্রার্থী হতে পারতেন না? কেন তাঁকে ভোট দিতে হবে?’ ভর সন্ধেবেলা। নওদার আমতলা বাজারে রাজ্য সড়কের পাশেই মাঠে সভা। বক্তৃতা চলছে। মাইকে ভেসে আসা প্রশ্নগুলি শুনতে শুনতে পায়ে পায়ে এগোনো গেল। কাদের সভা? কংগ্রেস? বাম? বিজেপি? কোনওটাই নয়।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৮
Share:

‘কে ইন্দ্রনীল সেন? তিনি তো বহিরাগত! কত দিন তৃণমূল করছেন? উড়ে এসে জুড়ে বসলেন? এখানকার কেউ কি প্রার্থী হতে পারতেন না? কেন তাঁকে ভোট দিতে হবে?’

Advertisement

ভর সন্ধেবেলা। নওদার আমতলা বাজারে রাজ্য সড়কের পাশেই মাঠে সভা। বক্তৃতা চলছে।

মাইকে ভেসে আসা প্রশ্নগুলি শুনতে শুনতে পায়ে পায়ে এগোনো গেল। কাদের সভা? কংগ্রেস? বাম? বিজেপি? কোনওটাই নয়। সাক্ষাৎ তৃণমূলের ঘাসফুল পতাকায় ছেয়ে রয়েছে সভাস্থল। নামে কর্মিসভা হলেও ভিড় ছোটখাটো জনসভার সঙ্গে তুলনীয়। এবং বক্তা স্বয়ং ইন্দ্রনীল সেন!

Advertisement

‘অ্যান্ড ব্রুটাস ইজ অ্যান অনারেব্ল ম্যান’ বাক্যবন্ধটি শেক্সপীয়র প্রায় প্রবচন করে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু প্রশংসার ছলে নিন্দা নামক এই ব্যাজস্তুতিকে নিজের ছকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে কী বলতে চান তৃণমূল প্রার্থী ইন্দ্রনীল? দলীয় কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে এবার তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র: “যাঁরা এ সব বলছেন, ঠিকই বলছেন। আপনারা এসব কথার কোনও প্রতিবাদ করতে যাবেন না। শুধু এটুকু বলবেন, ইন্দ্রনীল সেন নয়, এখানে যিনি লড়ছেন তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জিতলে তিনি জিতবেন, হারলে তিনি হারবেন। আমি শুধু তাঁর অনুগত সৈনিক হয়ে এসেছি।”

এনকোর! এনকোর!

গীতায় অর্জুনকে কৃষ্ণের উপদেশ ছিল, ফলের আশা না করে সব কিছু তাঁর উপর ছেড়ে দিয়ে কর্ম করে যেতে। লোকসভা ভোটের কুরুক্ষেত্রে ইন্দ্রনীল যেন সেই অর্জুন!

মমতা অবশ্য এত কথা তাঁকে বলেননি। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার দু-চার দিন আগে এক বার ফুস করে জানতে চেয়েছিলেন, “একটা টাফ সিট দিলে লড়বে?” সেই প্রস্তাব দু’হাত দিয়ে চেটেপুটে তুলে নিয়েছিলেন ইন্দ্রনীল: “তুমি যেখানে দেবে, যা বলবে তা-ই হবে দিদি।”

অতএব এটা পরিষ্কার যে, বহরমপুর তৃণমূলের পক্ষে কঠিন জমি। ইন্দ্রনীলের পক্ষে কঠিনতর কি না, সে প্রশ্নে অবশ্যই বিতর্ক তোলা যায়। কারণ কংগ্রেসের এক নম্বর ওয়েসিস, অধীর চৌধুরীর খাস তালুক বলে খ্যাত বহরমপুরে তৃণমূল তার হাজিরা জানান দিচ্ছে। শহরে তো বটেই, প্রত্যন্ত গ্রামের অন্দরেও পতপত করছে ঘাসফুলের পতাকা। দেওয়ালে দেওয়ালে ইন্দ্রনীল সেনকে জয়ী করার আহ্বান। এমনকী তিনি যে বিভিন্ন রোড-শো করছেন, সেখানেও জনসমাগম নজর কাড়ে। আরএসপি এবং বিজেপি বরং তুলনায় ম্রিয়মান।

দিদির শিবিরে ইন্দ্রনীলের আগমন ও উত্থান প্রায় উল্কার মতো। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের বাজারেও লোকজন ইন্দ্রনীল সেনকে বাম-ঘেঁষা ‘বুদ্ধজীবী’ বলেই চিনত। পরে নিজগুণে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরম আস্থাভাজন হয়ে উঠতে সফল হন। এটা নিশ্চিতভাবেই তাঁর কৃতিত্ব। দু-আড়াই বছরের এই চলার পথে অনেক সময় পা পিছলানোর ঝুঁকি সামলাতে হয়েছে তাঁকে। ব্যথা সয়েছেন মুখ বুজে। অনেকে বলেন, বহরমপুরের প্রার্থী পদ তারই স্বীকৃতি।

নিন্দুকেরা অবশ্য রটিয়ে বেড়াচ্ছেন, আসলে এটা না কি বাঘ মারতে ‘শত্রু’ পাঠানো। জিতলে ভাল, অধীরের গতবারের জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কিছুটা কমালে সেটিও মন্দ নয়। আর পরাজয়? তা-ও দল হিসেবে এ ক্ষেত্রে তৃণমূলের গায়ে সরাসরি লাগবে না। কারণ ইন্দ্রনীল তো ‘অতিথি’, সংগঠনের কেউ নন। হয়তো তাই ইন্দ্রনীলও ঢালের আড়ালে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। এক,অদ্বিতীয়, অনিবার্য সেই বর্মের ব্র্যান্ড ‘মমতা’।

‘কিন্তু শুধুই দিদি-দিদি করে, আমাকে দিদি পাঠিয়েছেন বলে, আর আমি দিদি-র স্নেহধন্য লিখে পোস্টার ছেপেই কি ভোট হয়ে যাবে?’ দলের অন্দরে এমন বেয়াড়া প্রশ্ন ঘাসফুলের কাঁটা হয়ে বারবার বিদ্ধ করছে ইন্দ্রনীলকে। তিনি সুরের জগতের মানুষ। বেসুরটা তাই কানে বেজেছে। দক্ষিণ কলকাতায় নিজের পাড়া থেকে ‘অনুগত’ বাহিনী নিয়ে এসে নিজের মতো করে টিম সাজাচ্ছেন। তাঁর দাদা ইন্দ্রজিৎ সেন ব্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছেন ভাইয়ের পাশে থেকে ভাঁড়ার সামলাতে। বহরমপুর শহরে লালদীঘির পাড়ে পারিজাত আবাসনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে এঁদের নিয়ে টিম-তাতনের (ইন্দ্রনীলের ঘরোয়া নাম) সোনার সংসার!

তা হলে এত বড় নির্বাচনী যজ্ঞে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের কোনও ভূমিকাই নেই? আছে, অবশ্যই আছে। বহরমপুর কেন্দ্রে দলের যুগ্ম সেনাপতি হুমায়ুন কবীর ও সুব্রত সাহা। সাতটি বিধানসভার মধ্যে হুমায়ুনের হাতে চারটির ভার, তিনটি সুব্রতের। শোনা যায়, গোড়ায় নাকি সাতটিই হুমায়ুনকে দেখতে বলা হয়েছিল। কয়েক দিন পরেই সুব্রত বক্সী এসে চার-তিনে ভাগ করে দিয়ে যান।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়। হুমায়ুন এবং সুব্রত কে কোনগুলি নেবেন, তা নিয়ে নিজেরা এ বার আলোচনায় বসেন। রেজিনগর হুমায়ুনের সাবেক জায়গা, বহরমপুর থেকে জিতেছেন মন্ত্রী সুব্রত। দু’টি বাদ দিয়ে হাতে রইল আরও পাঁচ। স্থির হল, নওদা, বড়োঞা, ভরতপুর দেখবেন হুমায়ুন, কান্দি ও বেলডাঙায় সুব্রত। উত্তম ব্যবস্থা। অকস্মাৎ উপরতলা থেকে নির্দেশ এল, বেলডাঙা হুমায়ুনকে দেখতে হবে। বড়োঞা বরং সুব্রত নিন। আপাতত এই বন্দোবস্তই কার্যকর। তবে কালনেমির লঙ্কাভাগের এই সাতকাহন বুঝিয়ে দেয়, তৃণমূল যাঁদের হাতে বহরমপুর নামক এই ভুবনের ভার দিয়েছে, তাঁরা নিজেরাই এখনও পর্যন্ত কত অবিন্যস্ত!

রেজিনগরের মাণিক্যহারে হুমায়ুনের বাড়ি। সুনসান দুপুরে তিনি একদম একা বসে। প্রচারের তুঙ্গ লগ্নে অন্যতম সেনাপতি এমন বিশ্রামে? হুমায়ুন স্বীকার করলেন, অন্য বার ভোটের সময় এ ভাবে বাড়িতে থাকার সুযোগ তাঁর হয়নি। প্রচারের ফাঁকে কোথাও কোনও না কোনও গ্রামে দুপুর কেটেছে। সে যখন তিনি কংগ্রেসে ছিলেন, তখনও। তা হলে এ বার কেন হল? উত্তরটা হাসিতেই জমিয়ে রাখলেন তিনি। তবে সন্ধ্যায় নওদার কর্মিসভায় হুমায়ুনের চল্লিশ মিনিটের ভাষণ ইন্দ্রনীলকে কম করেও চল্লিশ হাজার মাইল এগিয়ে রাখল!

অধীর চৌধুরী জেলা সফরে ব্যস্ত। নিজের কেন্দ্রে ঢোকার সময় কার্যত পাচ্ছেনই না। তাঁর দলের ছেলেরা কিন্তু এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দাবি করছেন, তৃণমূলের প্রার্থী ‘কম জোর’ বলেই অধীরের মাথাব্যথা কম! প্রকাশ্যে এ সব চর্চায় অবশ্য ইন্দ্রনীলের আদৌ আগ্রহ নেই। অর্জুনের মতোই লক্ষ্যভেদে স্থির থাকার কথা বলে চলেছেন তিনি। পলাশীর প্রান্তরে ‘শিবাজি’ হয়ে তিনি খাপ খুলতে এসেছেন কি না, সেই খোঁচাটাও অকাতরে হজম করে পাল্টা ঠাট্টায় বলতে পারছেন, “খাপ থেকে সাপ বেরোলে বাপ বলার সময় পাবে না। সেটা জানা আছে তো!” এবং মিটিং-মিছিল-পদযাত্রায় গাইছেন দিদি-র প্রিয় সেই গান: “ধরো হাল শক্ত হাতে.......।”

ঘরের মধ্যে সবাই জানেন, দিদির সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ইন্দ্রনীল শিখে নিয়েছেন চলার কোনও শেষ নাই, থামার চেষ্টা বৃথা তাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন