গুরুতর সমস্যা নেই, পিজি থেকে জেলেই ফিরছেন মদন

গুরুতর কোনও অসুস্থতা নেই। এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি রাখারও তাই কোনও প্রয়োজন নেই বলে শেষমেশ জানিয়ে দিলেন চিকিৎসকরা। এখন শুধু সারদা কেলেঙ্কারিতে ধৃত মন্ত্রী মদন মিত্রের জেলে ফেরার অপেক্ষা। মদনের জন্য যে মেডিক্যাল বোর্ড গড়া হয়েছিল, তার প্রথম বৈঠকে মদনের বেশ কিছু পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত হয়। সে সব পরীক্ষায় কোনও গুরুতর সমস্যা মেলেনি। শনিবার দ্বিতীয়বার বৈঠকে বসেই মেডিক্যাল বোর্ড তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধেয় লেখা হয় ডিসচার্জের চিঠি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৫৯
Share:

জেলে যাওয়ার নির্দেশ শোনার পরে মন্ত্রী। —ফাইল চিত্র

গুরুতর কোনও অসুস্থতা নেই। এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি রাখারও তাই কোনও প্রয়োজন নেই বলে শেষমেশ জানিয়ে দিলেন চিকিৎসকরা। এখন শুধু সারদা কেলেঙ্কারিতে ধৃত মন্ত্রী মদন মিত্রের জেলে ফেরার অপেক্ষা।

Advertisement

মদনের জন্য যে মেডিক্যাল বোর্ড গড়া হয়েছিল, তার প্রথম বৈঠকে মদনের বেশ কিছু পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত হয়। সে সব পরীক্ষায় কোনও গুরুতর সমস্যা মেলেনি। শনিবার দ্বিতীয়বার বৈঠকে বসেই মেডিক্যাল বোর্ড তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধেয় লেখা হয় ডিসচার্জের চিঠি। রাতেই আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষকে সে কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। এর পর শুরু হয় জল্পনা, কখন আবার জেলে ফেরানো হবে মদনকে।

রাতে কলকাতা পুলিশের এক কর্তা পিজিতে গিয়ে জানান, এ দিন রাতে মন্ত্রীকে জেলে ফেরানো হবে না। তিনি নিজেও তা-ই চান। হাসপাতালের একটি সূত্র অবশ্য বলছে, সাংবাদিকদের এড়াতেই হয়তো পুলিশকর্তা এ কথা বলেছেন। শনিবার গভীর রাতেই মদনকে জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

Advertisement

গত ক’দিন ধরেই মদনের ‘অসুস্থতা’কে নাটক আখ্যা দিয়ে যাচ্ছিলেন বিরোধীরা। কার্যত সেই অভিযোগই যে সত্য, এ দিন তা বেশ স্পষ্ট হয়ে গেল মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্তে। শনিবার বিকেলে বোর্ড জানায়, তাঁর আর হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। প্রশ্ন উঠছে, চিকিৎসকরা সমালোচনার চাপে পড়েই কি এটা করতে বাধ্য হলেন?

গত ১৯ ডিসেম্বর মদনকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক তাঁকে জেল হেফাজতে পাঠান। কিন্তু ওই দিন সন্ধেয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছনোর কিছু ক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী জানান, তাঁর বুকে ব্যথা হচ্ছে। তার পর তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

পিজিতে ভর্তি হয়ে মদন দাবি করেছিলেন, তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন, মনে হচ্ছে, কেউ যেন তাঁর গলা কেউ টিপে ধরছে। এর পরেই চিকিৎসকরাও ফলাও করে মদনের শারীরিক সমস্যার ফিরিস্তি দিতে শুরু করেন। মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা যথেষ্ট গুরুতর, এমন ইঙ্গিত দিয়ে গঠিত হয় মেডিক্যাল বোর্ডও। তার সদস্যরা মন্ত্রীর শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষার লম্বা তালিকাও তৈরি করেন। শুক্রবারও পিজি-র চিকিৎসকরা জানান, মন্ত্রী দুর্বল বলে জগিং করতে পারছেন না, তাই টিএম টেস্ট করা যায়নি। বৃহস্পতিবার চিকিৎসকরা জানান, মন্ত্রীর দমবন্ধ হয়ে আসছে বলে তাঁর এমআরআই করা হয়নি।

তবে কোন মন্ত্রবলে সব অসুস্থতা দূর হয়ে গেল? মদনের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সিবিআই চিকিৎসকদেরও জেরা করতে পারে, এমন গুঞ্জন শুরু হওয়াতেই কি এই সিদ্ধান্ত?

মন্ত্রীর জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান শিবানন্দ দত্ত খানিকটা উত্তেজিত হয়েই বলেন, “কোনও হাই প্রোফাইল বিচারাধীন বন্দি যদি বলেন, শরীর খারাপ লাগছে, তবে কোনও ঝুঁকি নেওয়া যায় না। কিছু হয়ে গেলে তো ডাক্তাররা দায়ী হবে।” শিবানন্দবাবুর বক্তব্য, “কিছু রোগ তো ওঁর ছিলই বা আছে। তার মাত্রা বেড়েছে কি না দেখতে তাঁকে সেই মুহূর্তে ভর্তি করে একাধিক পরীক্ষা করা জরুরি ছিল। পরীক্ষার রিপোর্ট আসার পর যখন দেখা যাচ্ছে অবস্থা ততটা খারাপ নয়, ছেড়ে দেওয়া যায়, সে জন্যই ছাড়া হচ্ছে। এর মধ্যে অন্য কারণ খোঁজা অর্থহীন।” চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এখন থেকে সাত দিন পর পর মন্ত্রীকে দেখে এলেই হবে।

মদন মিত্র পিজি-র কর্মী ইউনিয়নের নেতা ও রোগী কল্যাণ সমিতির সহ-চেয়ারম্যান। তিনি সেখানে ভর্তি হওয়ায় বিরোধীরা কটাক্ষ করেছিলেন, মন্ত্রী তো নিজের খাস তালুকে গেলেন, যেখানে তাঁর খাতির-যত্নের কোনও ত্রুটি হবে না। সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অঞ্জন বেরা মন্তব্য করেন, রাজ্যের হাসপাতালগুলো শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের ‘হলিডে হোম’-এ পরিণত হয়েছে। একই অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন কুণাল ঘোষ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলও। এখন তাঁরা বলছেন, “সব জায়গায় সমালোচনা হচ্ছিল, ছিছিক্কার হচ্ছিল। সিবিআই হয়তো এ বার কয়েক জন চিকিৎসককেই মন্ত্রীর অসুস্থতা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করত। চক্রান্ত ফাঁস হতে বসেছে দেখে আর মিথ্যা বলতে পারলেন না চিকিৎসকরা।”

শনিবার বরাকরে সিপিএমের সমাবেশে মহম্মদ সেলিমও দাবি করেন “মদন মিত্র সুস্থই রয়েছেন। চিকিৎসকদের কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই মদনবাবুকে হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। ওঁর যে কিছু হয়নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ওঁর নেত্রীও এক সময় এই পথে হেঁটেছিলেন।”

কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “রোগ নেই, অথচ মন্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে চিকিৎসকদের একাংশ যে জড়িত ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এখন তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।” বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও বলেন, “এটা সদর্থক পদক্ষেপ। তবে মানুষ মনে করছে, আরও কিছু দিন হাসপাতালে থাকলে মদনবাবু সত্যি সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়তেন!”

তেমন কোনও রোগই যদি না পাওয়া যায়, তবে কেন মদনকে ভর্তি করা হয়েছিল? এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের উত্তর, “বিষয়টা সাবজেক্টিভ। কেউ যদি বলেন তাঁর খুব শরীর খারাপ লাগছে, তবে চিকিৎসক বাইরে থেকে দেখে বুঝবেন না। তাঁকে ভর্তি করে নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। সে জন্যই মদন মিত্রকে ভর্তি করা হয়েছিল।” পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই চিকিৎসকেরা কেন মদনের নানা রকম অসুস্থতার কথা বলছিলেন? অধ্যক্ষের জবাব, “মন্ত্রীর আগে থেকেই অনেক রোগ রয়েছে। ডায়বেটিস, স্লিপ অ্যাপনিয়া, ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। সে কথাই বলা হয়েছিল।” পুরনো রোগের জন্য কি কাউকে ভর্তি করে এত দিন হাসপাতালে রেখে দেওয়া হয়? প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “পুরনো রোগ কখনও কখনও বেড়ে যায়। তখন ভর্তি করা যেতেই পারে। রোগের মাত্রা বুঝতে আমি তৎক্ষণাৎ বোর্ড গড়ে দিয়েছিলাম। মাঝে শনি-রবিবার পড়ে যাওয়ায় বোর্ড বসতে শুধু দু’দিন দেরি হয়েছিল।”

তবু প্রশ্ন উঠেছে, গুরুতর অসুখ নেই, পরীক্ষা করে তা জানতে ছ’দিন লাগল কেন? প্রদীপ মিত্রের জবাব, “হাসপাতাল প্রশাসনের দিক থেকে বলতে পারি, ইচ্ছাকৃত দেরি হয়নি। মাঝখানে বড়দিনের ছুটি থাকায়, আর কিছু পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে যতটুকু সময় লাগে, সেটুকুই শুধু দেরি হয়েছে।”

এ দিন সন্ধে থেকেই উডবার্ন ওয়ার্ডে নিজের কেবিনে পাজামা-পাঞ্জাবি-শাল-চপ্পল পরে জেলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসেছিলেন মদন। হাসপাতাল থেকে তাঁকে ছাড়া হবে বলে খবর ছড়ানোর পরেও অনুগামীদের তেমন ভিড় দেখা যায়নি পিজিতে। ছিল প্রচুর পুলিশ।

সারদা কেলেঙ্কারিতে আর এক অভিযুক্ত, তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু এখনও এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি। প্রদীপ মিত্র বলেন, “শিবানন্দ দত্ত সৃঞ্জয়কেও দেখছেন। উনি বললেই আমরা ছেড়ে দেব।” শিবানন্দবাবু এ ব্যাপারে বলেন, “সৃঞ্জয় বসু-র একটা রিহ্যাব থেরাপি চলছে। সেটা শেষ হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”

হাসপাতাল পর্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন