বাঁধানো গঙ্গাপাড়। হাওড়ার বাজে কদমতলায়। —নিজস্ব চিত্র
গঙ্গাতীরকে সুন্দর করতে একের পর এক নির্মাণ করছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু সেই নির্মাণ গঙ্গার পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কতটা উপযোগী, সে প্রশ্ন তুলে দিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। শুক্রবার কলকাতায় আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ জানিয়েছে, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়া আপাতত সাগর থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত গঙ্গার পাড়ে কোনও নির্মাণ করা যাবে না। ফলে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় গঙ্গাতীর সৌন্দর্যায়ন স্থগিত হয়ে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
রাজ্যে পালাবদলের পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছায় সরকার মহানগরের গঙ্গাপাড় সাজানোর কাজে লাগে। প্রিন্সেপ ঘাট থেকে শুরু করে প্রায় হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত গঙ্গাপাড় বাঁধিয়ে এবং সাজিয়ে তোলা হচ্ছিল। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে গঙ্গার মধ্যে নির্মাণকাজ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর বক্তব্য ছিল, নদীর মধ্যে নির্মাণকাজ বেআইনি। তা ছাড়া, এই ধরনের কাজের সময়ে পরিবেশগত সমীক্ষা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে যা করা হয়নি। “সৌন্দর্যায়নের কাজ করতে গিয়ে নদীকেই নষ্ট হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে,” বলছেন এই পরিবেশকর্মী।
মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন, কলকাতাকে লন্ডন করে তুলবেন। লন্ডনে যেমন টেমসের পাড় ঘেঁষে সাজানো বাগান-পথঘাট রয়েছে, এ শহরেও তেমনই করার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু সুভাষবাবু বলছেন, “লন্ডনে টেমসের পাড় ঘেঁষে পায়ে হাঁটার বাঁধানো পথ থাকলেও নদী ও পরিবেশের ক্ষতি করা হয়নি।”
সুভাষবাবু জানান, ২০১৩ সালের মাঝামাঝি তিনি এ বিষয়টি রাজ্য সরকারকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনও কাজ না হওয়ায় ২০১৪-র অগস্ট মাসে তিনি নিজে ফের গঙ্গার পাড় পরিদর্শন করেন। তখনও দেখেন, পরিবেশের তোয়াক্কা না করেই সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে। অবশেষে গত ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতায় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলাতেই শুক্রবার বিচারপতি প্রতাপ রায় ও বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়া সাগর থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত গঙ্গাপাড়ে কোনও রকম নির্মাণকাজ করা যাবে না।
সুভাষবাবু জানান, শুধু এই নির্দেশ দেওয়াই নয়, গঙ্গাপাড়ের এই নির্মাণ নিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব ও কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যানের রিপোর্ট চেয়েছে আদালত। গঙ্গার পূর্ব দিকে টালিগঞ্জ থেকে দক্ষিণেশ্বর এবং পশ্চিম দিকে নাজিরগঞ্জ থেকে বালিখাল পর্যন্ত নদীতীরের নির্মাণগুলি বৈধ কি না, তা জানিয়ে মুখ্যসচিবকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে। ওই সব নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, বন্দরের চেয়ারম্যানকে তা দু’সপ্তাহের মধ্যে জানাতে বলেছে পরিবেশ আদালত। এই মামলায় কেএমডিএ, কলকাতা ও হাওড়া পুরসভা, কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট এবং জাতীয় গঙ্গা অববাহিকা কর্তৃপক্ষকেও অংশীদার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কলকাতার গঙ্গায় একটি ভাসমান হোটেল রয়েছে। তা নিয়ে এ দিন আদালতে সুভাষবাবু বলেন, ওই হোটেলের বর্জ্য গঙ্গায় দূষণ ঘটাচ্ছে। বস্তুত, বিষয়টি তিনি এর আগে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকেও জানিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতে পর্ষদ ওই হোটেলকে বর্জ্য গঙ্গায় ফেলতে নিষেধ করেছে। নিকাশি শোধন যন্ত্র বসানোরও নির্দেশ দিয়েছে। এ দিন আদালত পর্ষদকে ওই হোটেল নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলেছে, জানান সুভাষবাবু।
আদালতের নির্দেশ না দেখে সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তবে তাঁর দাবি, “পরিবেশ নষ্ট করে সৌন্দর্যায়নের কাজ করা হয়নি। আগে গঙ্গার পাড়ের কী দশা ছিল এবং এখন কী হয়েছে, তা মানুষ দেখছেন।” আদালত কী বলেছে, তা সরকারি ভাবে না জেনে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি নগরোন্নয়ন দফতরের সচিব দেবাশিস সেন। তবে দফতরের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “নিয়ম না মেনে আমরা কোনও কাজ করি না।”