চব্বিশ কোটি খুইয়েই রেজিস্ট্রি লেক মলের প্রথম লিজ-চুক্তি

চব্বিশ কোটি টাকা রাজস্ব হাতছাড়া করে মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছে কলকাতা পুরসভা। যে লক্ষ্যে লেক মলের চুক্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল দু’ভাগে। এই সংক্রান্ত প্রথম চুক্তিটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সম্প্রতি নথিবদ্ধও করে নিল। দ্বিতীয়টির রেজিস্ট্রিও স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে প্রশাসনের একাংশের ধারণা।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২০
Share:

লেক মলের একাংশ।

চব্বিশ কোটি টাকা রাজস্ব হাতছাড়া করে মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছে কলকাতা পুরসভা। যে লক্ষ্যে লেক মলের চুক্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল দু’ভাগে। এই সংক্রান্ত প্রথম চুক্তিটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সম্প্রতি নথিবদ্ধও করে নিল। দ্বিতীয়টির রেজিস্ট্রিও স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে প্রশাসনের একাংশের ধারণা।

Advertisement

অর্থাৎ, হাজারো প্রতিবাদ, বিতর্ক, সমালোচনা সত্ত্বেও আগামী তিরিশ বছরের জন্য শ্রীকান্ত মোহতার ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন যে লেক মলের লিজ হোল্ডার হচ্ছে, তা পাকা হয়ে গেল। আর এই বাবদ তাঁকে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হচ্ছে সাকুল্যে ৯ লক্ষ টাকা। গত ১৪ জানুয়ারি আলিপুরে জেলা রেজিস্ট্রি দফতরে লেক মলের প্রথম তিরিশ বছরের চুক্তিটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। লিজের দলিল অনুযায়ী, সম্পত্তিটির বর্তমান বাজারদর ১৭২ কোটি টাকা। এবং ১৯৮৭-র মূল চুক্তি মানা হলে এই রেজিস্ট্রেশন বাবদই স্ট্যাম্প ডিউটি লাগত অন্তত ২৪ কোটি (বাজারদরের নির্ধারিত ৭% হারে)।

প্রশাসনের অন্দরে অভিযোগ, কোষাগারে যেখানে চরম টানাটানি, যেখানে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া ডিএ মেটানো যাচ্ছে না, সেখানে সরকারি তহবিলের কোটি কোটি টাকা লোকসান পুইয়েই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের ওই ব্যবসায়ীকে অন্যায় সুবিধা দেওয়া হল। বস্তুত অর্থ দফতরের একাধিক আমলার আপত্তিতে পরবর্তী তিরিশ বছরের চুক্তিটি আপাতত আটকে আছে। যদিও তাতে কতটা কাজ হবে, সে সম্পর্কে তাঁরাই সন্দিহান। “সকলেই জানে যে, চুক্তি ভেঙে দু’ভাগ করাটা আসলে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার কারসাজি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নিজে যদি তাতে প্রশ্রয় দেন, তা হলে রোখা কঠিন।” আক্ষেপ করেছেন নবান্নের একাধিক অফিসার। তাঁদের আশঙ্কা, সরকারের শীর্ষ মহলের চাপ এলে যে কোনও দিন পরবর্তী দফার চুক্তি রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাবে।

Advertisement

পুর-নথি মোতাবেক, ১৯৮৭ সালে লেক মল নিয়ে পুরসভার সঙ্গে অরুণ প্লাস্টিক সংস্থার (যার পরিবর্তিত নাম ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন, বলছে পুর-সূত্র) চুক্তি হয়েছিল ৬০ বছরের। রাজ্যের স্ট্যাম্প ডিউটি আইন (ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্প, ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১২) অনুযায়ী লিজ-চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছরের বেশি হলে লিজ রেজিস্ট্রেশন করাতে সম্পত্তির বাজারদরের ৭% হারে স্ট্যাম্প ডিউটি লাগে। এখানে যার অঙ্ক প্রায় ২৪ কোটি টাকা। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর বা তার কম হলে লিজ-ভাড়া হিসেবে স্ট্যাম্প ডিউটি ধার্য হয়। এ ক্ষেত্রে তা ৯ লক্ষ। অভিযোগ, ভেঙ্কটেশকে ‘সুবিধা’ দিতেই পুর প্রশাসন ৬০ বছরের চুক্তিকে তিরিশ বছর করে দু’ভাগে ভেঙে দিয়েছে।


রেজিস্ট্রি করা সেই চুক্তি। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

স্ট্যাম্প ডিউটির কোটি কোটি টাকা সাশ্রয়ের সুযোগ শুধু নয়, চুক্তিতেও ভেঙ্কটেশকে নানান ‘অন্যায্য’ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। কী রকম? পুর-সূত্রের খবর: আগের চুক্তিতে ছিল, ভবন সংস্কারের সময় ডেভেলপার সংস্থা প্রয়োজনে রাষ্ট্রায়ত্ত

ব্যাঙ্কের ঋণ নিতে পারবে। অর্থাৎ, বিল্ডিং সংস্কার হয়ে গেলে ঋণ নেওয়ার প্রশ্ন থাকছে না। কিন্তু এখনকার চুক্তিতে বলা হয়েছে, লিজ হোল্ডার তাঁর অধীনে থাকা জায়গা (এখানে বিল্ডিং) বন্ধক বা লিয়েন দিয়ে ব্যাঙ্ক-ঋণ নিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পুরসভার অনুমোদন নিতে হবে।

পুর-রাজস্ব আধিকারিকদের মতে, কাউকে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার এই রাস্তা সম্পূর্ণ নিয়মবিরুদ্ধ তো বটেই, বিপজ্জনকও। “কোনও ডেভেলপার এ ভাবে কোটি কোটি ঋণ নিয়ে না-শুধলে পুরসভার নিজস্ব বিল্ডিং ব্যাঙ্কের জিম্মায় চলে যেতে পারে।” বলছেন এক জন।

আর সেই আশঙ্কা যে একেবারে ভিত্তিহীন নয়, ইতিমধ্যে তার ইঙ্গিতও মিলেছে বলে পুর-সূত্রের দাবি। জানা গিয়েছে, ভেঙ্কটেশ-কর্ণধার শ্রীকান্ত ঋণ নেওয়ায় পুর-অনুমোদন চেয়ে দিন কয়েক আগে পুর-কমিশনার খলিল আহমেদকে চিঠি দিয়েছেন। তাতে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে পুরসভার অনুমতি চান। জয়েন্ট মিউনিসিপ্যাল কমিশনার (রেভিনিউ)-এর হাত ঘুরে চিঠিটি আপাতত পুরসভার আইন দফতরের বিবেচনাধীন। আধিকারিক মহলের কী বক্তব্য?

কেউই এমন অনুমোদন দেওয়ার পক্ষপাতী নন। সরকারি ভাবে মুখ না-খুললেও একান্ত আলাপচারিতায় ওঁদের কেউ-কেউ বলছেন, নতুন ভাবে লেক মল তৈরির কাজ এক বছর আগে শেষ হয়েছে। মল খুলেও গিয়েছে।

এখন কেন ঋণ নেওয়ার আবেদন, তা যাচাই করা দরকার। “পুর-সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা হলে আটকানো উচিত।” মন্তব্য এক অফিসারের। পুর-কমিশনার খলিল আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছু বলতে অস্বীকার করেন।

শ্রীকান্ত মোহতাকেও বার বার ফোন করে পাওয়া যায়নি। এসএমএসের উত্তরও আসেনি। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য শুক্রবার উত্তরবঙ্গ থেকে বলেন, “আমি এ সব ব্যাপারে কিছু জানি না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন