কনকনে শীতের রাত। ঝুপঝুপ করে বৃষ্টিও হচ্ছিল। শ্বাসকষ্টের রোগী সজল ঘোষ সাধারণত এমন দিনে বাড়ি থেকে বেরোতে চাইতেন না।
পূর্বস্থলীতে সজলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দু’এক জনের মতে, সে দিন সজলের শরীরটাও তেমন ভাল ছিল না। সন্ধ্যাতেই তিনি দু’এক জনকে সে কথা জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও রাতে এক নেতার ডাকে তিনি বাড়ি থেকে বেরোন। সম্ভবত খেয়েও বেরোননি।
সে দিন, ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি বর্ধমানের পূর্বস্থলী কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন জমা নিয়ে এসএফআই এবং টিএমসিপি-র মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। টিমসিপি-র দুই এবং এসএফআইয়ের এক ছাত্র জখম হয়ে নদিয়ার নবদ্বীপ হাসপাতালে ভর্তি হন। তৃণমূলের অভিযোগ, দলের ছাত্র সংগঠনের দুই সমর্থককে দেখতে রাতে হাসপাতালে গিয়েই খুন হন সজল। পূর্বস্থলী উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়-সহ বেশ কয়েক জন তখন সেখানেই ছিলেন।
তৃণমূলের পাঁচ ‘প্রত্যক্ষদর্শী’র অভিযোগের ভিত্তিতে সিপিএমের পূর্বস্থলী জোনাল সদস্য প্রদীপ সাহা-সহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। কিন্তু গত বুধবার তাঁরা সকলেই বেকসুর খালাস হয়ে যাওয়ায় অভিযোগের সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। সিপিএমের দাবি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে অন্য জায়গায় খুন করে সজলকে হাসপাতালে এনে ফেলা হয়েছিল। সেই কারণেই ওই রাতে জরুরি বিভাগে থাকা চিকিৎসক (যিনি হাসপাতালে কোনও গুলির শব্দ শোনেননি) সজলের জামা খুলে ব্যান্ডেজ দেখতে পেয়েছিলেন। তখনই গুলি করা হয়ে থাকলে যা অসম্ভব।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, ওই সন্ধ্যায় সজল কোথায় কাদের সঙ্গে ছিলেন? অসুস্থতা সত্ত্বেও বৃষ্টির মধ্যে তিনি বেরোলেনই বা কেন? পূর্বস্থলীর চুপিগ্রামে সজলের বাড়ির লোকজন রায়ের দিন থেকেই মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। এ দিন বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। কিন্তু দল ও পরিচিতদের সূত্রে সজলের গতিবিধির কিছুটা হদিস মিলেছে।
তৃণমূলেরই একটি সূত্রের দাবি, কলেজে মনোনয়ন জমার বিষয়টি তদারক করে বেলা দেড়টা নাগাদ সজল বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। স্নান-খাওয়া সেরে দুপুর আড়াইটে নাগাদ তিনি স্থানীয় চুপি অকিঞ্চন অক্ষয়কুমার পাঠাগারে একটি অনুষ্ঠানে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এলাকার দুই প্রাথমিক শিক্ষকও। সন্ধ্যা ৭টার পরে দু’জন সাইকেলে চেপে এসে বলে, “তপনদা ডাকছেন।” খানিক বাদে সজল বাড়ি গিয়ে সোয়েটার পরে আবার বেরিয়ে আসেন। তখন ৮টা বেজে গিয়েছে।
বাড়ি থেকে কোথায় গিয়েছিলেন সজল? ‘তপনদা’ মানে কি তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়?
শনিবার তপনবাবু বলেন, “এটা নতুন কিছু নয়। পূর্বস্থলীতে আমার বাড়িতেই পার্টি অফিস। নেতা-কর্মীরা রোজই আসেন। সে দিনও অনেকেই এসেছিলেন। পরের দিন বিধানসভায় অধিবেশনে যাওয়ার ছিল আমার। তাই রাতে ওদের বললাম, ‘চল, কলকাতা যাওয়ার আগে হাসপাতালে ছেলেগুলোকে দেখে আসি।’ সজলও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল।” বিধায়কের সঙ্গে নবদ্বীপ হাসপাতালে গিয়েছিলেন পূর্বস্থলী পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান পঙ্কজ গঙ্গোপাধ্যায়ও। পরে তিনিই নিজেকে ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ বলে দাবি করে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন।
সজলের চার দাদা-দিদির মধ্যে এক মাত্র যিনি কথা বলেছেন, তিনি তাঁর বড় দিদি রীতা রায়। বিবাহসূত্রে তিনি এখন হুগলির চুঁচুড়ার বাসিন্দা। রাজ্য কৃষি দফতরের কর্মী রীতাদেবী ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর আক্ষেপ, “বাবা-মা কেউ কোনও দিন চাননি যে ভাই রাজনীতি করুক। বাবা যত দিন বেঁচেছিলেন, খালি বলতেন ‘ভদ্রলোকে রাজনীতি করে না’। সেই কথাটাই প্রমাণ হয়ে গেল।”
কেন সজলকে খুন হতে হল, সে ব্যাপারে কোনও ধারণা আছে?
রীতাদেবী বলেন, “কিছু জানি না, বিশ্বাস করুন। ভাই এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। বহু মানুষ এখনও ওর জন্য কাঁদেন। কে ওকে মারল?”
ওই জনপ্রিয়তাই কি তবে সজলের কাল হল?
কান্না জড়ানো গলায় দিদি বলেন, “এর উত্তর আমার জানা নেই। ভাই আর ফিরবে না। কিন্তু খুনির শাস্তি না হলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না।”