কখনও সারদা, কখনও যাদবপুর। কখনও সুগত বসু, কখনও সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
সারদা-কাণ্ডে যারা টাকা নয়ছয় করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে মাত্র পাঁচ দিন আগে দলকে অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন যাদবপুরের তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিড়ম্বনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে শুক্রবার তাঁর মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানালেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাজ্যপালের কাছ থেকে শংসাপত্র না নিয়ে অহিংস আন্দোলনের যে নজির তৈরি করেছেন ছাত্রী গীতশ্রী সরকার, তাকে তিনি সম্মান জানাচ্ছেন!
যাদবপুরের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহে এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে অস্বস্তিতে রয়েছে রাজ্য সরকার তথা শাসক দল। এমনকী ছাত্রছাত্রীদের ‘হোক কলরব’ মিছিলের পাল্টা মিছিল রাস্তায় নামিয়েও সেই অস্বস্তি লাঘব হয়নি তৃণমূল নেত্রীর। তার উপরে এ দিন সুব্রতবাবুর মন্তব্য রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দেয় দলের অন্দরে! উত্তরবঙ্গে পৌঁছে সে কথা কানে যায় নেত্রীরও। তৃণমূল সূত্রের দাবি, প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে সুব্রতবাবুকে ফোন করেন মমতা। জানিয়ে দেন, সমাবর্তনের ওই ঘটনার পরে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যা বলেছিলেন, সেটাই দলের বক্তব্য। কাজেই তিনি যেন এমন মন্তব্য না করেন। সমাবর্তনের মঞ্চে ওই ঘটনার পরে ছাত্রছাত্রীদের সমালোচনা করছিলেন পার্থবাবু। এ দিন তিনি আবার বিতর্কের মধ্যে ঢুকতেই চাননি! দলের অবস্থান বোঝাতে শেষ পর্যন্ত নেত্রীর নির্দেশে রাতে বিবৃতি দিয়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম! স্বভাবতই তিনি হেঁটেছেন সুব্রতবাবুর উল্টো পথে!
কী বলেছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী?
এ দিন সিউড়ির শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের হীরক জয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধন করতে যান তিনি। অনুষ্ঠানের পরে যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সুব্রতবাবু বলেন, “ছাত্রছাত্রীরা কী নিয়ে আন্দোলন করছে, তা ন্যায্য, না অন্যায্য সে সব আমি জানি না। জ্ঞানীগুণী জনেরা সে সব বিচার করবেন! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের সেরা ছাত্রী যে ভঙ্গিমায় অহিংস পথে, বিনম্র ভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তাকে আমি সম্মান না জানিয়ে পারছি না। এই বিনম্র, বিনয়ী প্রতিবাদ কতটা শক্তিশালী ও প্রকট হতে পারে, প্রশাসন তা বুঝেছে!”
প্রবীণ এই নেতা নিজেও ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনীতিতে উঠে এসেছেন। তাঁর মতে, এখনকার ছাত্র আন্দোলন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংস হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনের নামে মারদাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু গীতশ্রী যা ‘করে দেখিয়েছেন’, তা তিনি কখনও দেখেননি এবং নিজেও করেননি। তাই গীতশ্রীকে তিনি নির্দ্বিধায় বারবার সম্মান জানাবেন। নিজের দফতর মারফত এ দিন গীতশ্রীর টেলিফোন নম্বরও জোগাড় করেছিলেন সুব্রতবাবু। কিন্তু চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেননি। গীতশ্রী অবশ্য মালদহে নিজের বাড়িতে বসে সুব্রতবাবু মন্তব্যের খবর পেয়েছেন। শুনে বলেছেন, “যাঁরা সংবেদনশীল, তাঁরাই আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছেন। সুব্রতবাবুও সংবেদনশীলতার দৃষ্টিতেই বিষয়টি দেখছেন বলে মনে হয়।”
যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া অবশ্য বিচিত্র! আগে বলেছিলেন, ‘গীতশ্রী রাজনীতির শিকার’। এ দিন তাঁর দাবি, “পঞ্চায়েতমন্ত্রী ওই ছাত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা! সুব্রতবাবুকে অপবাদ দেওয়ার জন্য, তাঁকে ছোট করার জন্য এই সব করা হচ্ছে!” রাতে আসরে নামেন মন্ত্রী ফিরহাদ। বলেন, “সিনিয়রদের অসম্মান করা আমাদের সংস্কৃতি নয়। প্রতিবাদ করতে চাইলে ছাত্রছাত্রীরা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে না এসেও তা করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যপালকে অসম্মান করাকে শোভন বলা যাবে না!” বস্তুত, এটাই মমতার অবস্থান।
অনুজ মন্ত্রীকে দিয়ে যে কার্যত তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলানো হয়েছে, রাতে সেই খবর পৌঁছে গিয়েছে সুব্রতবাবুর কানেও। জল এত দূর গড়িয়েছে দেখেও কিন্তু অবস্থান বদলাননি পঞ্চায়েতমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্যে সরকার-বিরোধিতার কিছু ছিল, এমন ব্যাখ্যাও মানতে চাননি। সুব্রতবাবুর কথায়, “ঘটনাটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়, তার ছাত্রছাত্রী, উপাচার্য-আচার্যকে নিয়ে। আমার বক্তব্য কেবল ওই মেয়েটির প্রতিবাদের পন্থা নিয়ে। এ সব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলে তো ভালকে ভাল, মন্দকে মন্দ বলাই যাবে না!”
মনে করিয়ে দেওয়া যাক, মাসতিনেক আগে যাদবপুরের পুলিশ ঢোকার নিন্দা করেছিলেন সুব্রতবাবুই। তখনও এক প্রস্ত বিতর্ক বাধে। এর পরে সারদা-সহ নানা ঘটনায় আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে সুব্রতবাবুর এ দিনের মন্তব্য তৃণমূলের অন্দরে নতুন জল্পনার জন্ম দিয়েছে। ক’দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রীকে মঞ্চে বসিয়ে ধাপায় একটি জল-প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, বিনা পয়সায় মানুষকে জল খাওয়াতে কষ্ট হয়। তবু মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছেন বলে খাওয়াচ্ছেন! তার কয়েক দিনের মধ্যেই এই মন্তব্য শুনে তৃণমূলের এক রাজ্য নেতা বলেছেন, “সুব্রতদা’র মাথায় মনে হচ্ছে কোনও পরিকল্পনা আছে!”
তৃণমূলের একাংশের মতে, সুগত বসু যখন সারদা নিয়ে বলেছিলেন, তখন তিনি কারও নাম করেননি। তা ছাড়া তিনি রাজনীতিতে নবাগত। তাই নেত্রীও এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেননি। কিন্তু সুব্রতবাবু পোড় খাওয়া রাজনীতিক, প্রবীণতম মন্ত্রী এবং মমতার দলের মুখপাত্র। তিনি এমন মন্তব্য করা মানে যাদবপুর-কাণ্ড নিয়ে কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই যাওয়া! তাই এত রুষ্ট হয়েছেন মমতা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সুগতবাবুও কিন্তু সুব্রতবাবুর বক্তব্যের বিরোধিতা করেননি। তাঁর মতে, কাউকে অসম্মান না করে বিনম্র ভাবে প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সকলের আছে।তবে আচার্যকেও সম্মান জানানো উচিত মনে করেন তিনি। আর এক শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার জানিয়েছেন, বয়কটের রাস্তায় না হেঁটে ছাত্রীটি ‘অত্যন্ত ভদ্র ভাবে’ যা করেছিলেন, তাতে প্রতিবাদ আরও জোরালো হয়েছে। সুব্রতবাবুর সঙ্গে তিনি একশো ভাগ একমত।
সব মিলিয়ে শাসক দলে আরও তীব্র হয়েছে যাদবপুর-যন্ত্রণা। রাজনৈতিক বিরোধীরাও সুব্রতবাবুর পাশে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “উনি ভালই বলেছেন। প্রতিবাদী ছাত্রীকে আমরা আগেই অভিনন্দন জানিয়েছি। সুব্রতবাবু যা বলছেন, সেটা নিজের সরকারকে বোঝান!”
সুব্রতবাবুর মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানও। ঘটনার দিন থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের নিন্দা করায় তৃণমূলের এই অস্বস্তির ফায়দা শুধু নিতে পারছে না বিজেপি!
দলে সুব্রতবাবুর ঘনিষ্ঠ এক নেতারই মন্তব্য, “ভালই তো! সুব্রতদা যা বলার বলেছেন। এ বার মানুষ বুঝে নেবেন!”