ছাদনাতলায় বালিকা বধূ, পিছিয়ে নেই কলকাতাও

ফর্সা, ছিপছিপে তরুণী। মাথায় সিঁদুর। বাড়ির বাইরে পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে গল্প করছেন। নাম জিজ্ঞাসা করতেই চোখে সন্দেহের দৃষ্টি “কী দরকার?” বোঝা গেল, সরাসরি জবাব দিলে সমস্যা হবে। তাই আলটপকা গল্প জুড়তে হল। কথায়-কথায় বয়স শুধোতে তরুণী বললেন, “উনিশ পেরিয়ে কুড়িতে পড়েছি।” আরও জানালেন, সামনে খেলে বেড়ানো বাচ্চাটি ওঁরই ছেলে! বয়স আড়াই।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩২
Share:

ফর্সা, ছিপছিপে তরুণী। মাথায় সিঁদুর। বাড়ির বাইরে পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে গল্প করছেন। নাম জিজ্ঞাসা করতেই চোখে সন্দেহের দৃষ্টি “কী দরকার?”

Advertisement

বোঝা গেল, সরাসরি জবাব দিলে সমস্যা হবে। তাই আলটপকা গল্প জুড়তে হল। কথায়-কথায় বয়স শুধোতে তরুণী বললেন, “উনিশ পেরিয়ে কুড়িতে পড়েছি।” আরও জানালেন, সামনে খেলে বেড়ানো বাচ্চাটি ওঁরই ছেলে! বয়স আড়াই।

ইএম বাইপাস লাগোয়া ধাপার বাসিন্দা মেয়েটির বিয়ে হয়েছে পনেরো বছর বয়সে। সতেরো না-পুরোতেই মা!

Advertisement

বিরল কিছু নয়। শিশুকল্যাণ সমিতির কর্তারা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন সমীক্ষায় খাস কলকাতায় নাবালিকা বিয়ের দাপুটে চেহারা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। খবর পেলে আটকানো হয়। কিন্তু সে আর ক’টা? তা ছাড়া জেলায় জেলায় বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুন বা সুনীতা মাহাতোর মতো কিছু প্রতিবাদী স্বর শোনা গেলেও সিংহভাগের ক্ষমতা হয় না পরিবারের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। অনেকে আবার মা-বাবার অমতে পছন্দের ছেলের সঙ্গে ঘর বাঁধে। বিয়ের টোপে ভুলে কেউ কেউ পড়ে যায় পাচারচক্রের খপ্পরে।

ফলে পড়াশোনা আর খেলে বেড়ানোর বয়সে ঘর-গেরস্থালি-বাচ্চা নিয়ে দিন কাটে বহু বালিকা বধূর। সম্ভাবনার বহু কুঁড়ি ঝরে যায় অকালে। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, গত প্রায় ছ’মাসে শুধু কলকাতায় ৪৯টি নাবালিকা বিয়ের অভিযোগ জমা পড়েছে। এর দশটিতে বাড়ির লোকই জবরদস্তি বিয়ে দিচ্ছিলেন। সংস্থার কো-অর্ডিনেটর দিলীপ বসুর কথায়, “আমাদের হেল্পলাইনে ফি মাসে গড়ে দশটা অভিযোগ আসে। তবে অনেক সময়ে ঠিকানা-বিভ্রাটের দরুণ বিয়ে আটকানো যায় না।”

দিলীপবাবুদের সংগঠন আরও পাঁচ জেলায় কাজ করে। সেখানে অভিযোগের বহরও বেশি। ইউনিসেফের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে এক সরকারি আধিকারিকের তথ্য: দেশে নাবালিকা বিবাহের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের আগে রয়েছে বিহার। তারও আগে রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্র। তালিকার শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ। মহারাষ্ট্র-ওড়িশা-গুজরাত-তামিলনাডু গত ক’বছরে অনেকটা সাফল্য পেয়েছে। এ রাজ্যে নাবালিকা বিবাহে অগ্রগণ্য জেলাগুলো হল মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। সমাজকল্যাণ-সূত্রের দাবি: বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক সম্পর্কের জেরে গর্ভবতী হয়ে পড়ার ঘটনা ইদানীং বাড়ছে, যা নাবালিকা বিয়ের সংখ্যাবৃদ্ধির একটা বড় কারণ।

নাবালিকার গর্ভসঞ্চারে অশনি সঙ্কেত দেখছেন চিকিৎসকেরাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই বয়সে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে সন্তানধারণের জন্য তৈরি থাকে না। গাইনোকলজিস্ট তরুণকান্তি ঘোষ বলেন, “শরীর উপযোগী না-হওয়ায় গর্ভে সন্তানের পূর্ণ বিকাশ ঘটে না। ওই অবস্থায় সন্তান জন্ম নিলে পরে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায়। কখনও সন্তান হয় অপরিণত। এমনকী, বাচ্চার মৃত্যুও হতে পারে।”

বিপর্যয় রোধের দাওয়াই কী?

প্রশাসন ও চিকিৎসক মহলের মতে, সচেতনতাই আসল ওষুধ। রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী (স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত) শশী পাঁজার আশা, “স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে প্রচার চালালে ভাল ফল মিলবে।”

কখনও-সখনও অবশ্য আত্মীয়-পরিজনের সচেতনতায় মেয়েরা রক্ষা পাচ্ছে। যেমন পেয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার রিয়া (নাম পরিবর্তিত)। বছর চোদ্দোর মেয়েটি গত বছর পড়শি এক যুবকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়েছিল। হাওড়ার বাউরিয়ার এক মন্দিরে বিয়ে করে দু’জনে ছেলের মাসির বাড়িতে গিয়ে ওঠে। কিন্তু নাবালিকা বৌ দেখে মাসি-ই পুলিশে খবর দেন। ততক্ষণে মেয়ের পরিবারও নিখোঁজ-ডায়েরি করে ফেলেছে। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীরা রিয়াকে ফিরিয়ে আনে। তার পরে?

রিয়া জানাচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবী দিদিরা ওকে বুঝিয়েছেন, কম বয়সে বিয়ে করা উচিত নয়। বরং পড়াশোনায় মন দিতে হবে। তাই সে ফের পড়াশোনা শুরু করেছে। “ওঁরাই আমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন।” বলছে রিয়া। শিশুকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান অমিত ভট্টাচার্য জানান, ২০১৩-র সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪-র ১৫ মার্চ পর্যন্ত ‘বিবাহিতা’ ২৩ জন নাবালিকাকে সমিতিতে হাজির করানো হয়েছে।

নাবালিকা বিয়ে নিয়ে পুলিশেরও একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। তাদের বক্তব্য: মূলত গরিবগুর্বো বাড়ির মেয়েদেরই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে ‘পার করা’র চেষ্টা হয়। এবং পাচারকারীরা সে মওকা কাজে লাগায়। “বিয়ের নামে বাচ্চা মেয়েদের ভিন রাজ্যের যৌনপল্লিতে বেচে দেওয়ার দৃষ্টান্ত আকছার।” মন্তব্য এক পুলিশ-কর্তা।

নাবালিকা বিয়ে

• ভারতের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ

• রাজ্যের মধ্যে শীর্ষে মুর্শিদাবাদ জেলা

• কলকাতাতেও দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে

• অনেক ক্ষেত্রে নারীপাচার চক্রের হাত থাকে

• নাবালিকা প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যুর ভয় বেশি

• দুয়েরই নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা

• শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষায় ঘাটতি

সূত্র : ইউনিসেফ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন