তাঁর ঝুলিতে ১৪টা আট হাজারি শৃঙ্গ জয়ের খেতাব। ২০১০ সালে তিন মাসের মধ্যে চারটে শৃঙ্গ ছুঁয়ে এসেছিলেন। তিনি জানেন, মরি তো মরব, এই ভেবেই এগিয়ে চলেন আরোহীরা। যুক্তি-ক্লান্তি কিছুই দমাতে পারে না সেই জেদকে।
ইনি মিংমা শেরপা। ছন্দা গায়েনদের অভিযানের ব্যবস্থাপক সংস্থার কর্ণধার। নিজেও এক জন পর্বতারোহী ছিলেন। বছর চারেক হল অভিযান আয়োজনের ব্যবসা শুরু করেছেন। ক্লান্তি-ই ছন্দার বিপদের কারণ হল কি না, জিজ্ঞাসা করাতে ওপরের কথাগুলোই বললেন মিংমা। বললেন, “আসলে যে কোনও দিনও চুড়োয় পা রাখেনি, শৃঙ্গ জয়ের নেশাটা তাকে বোঝানো সম্ভব নয়। মরি তো মরব, এ রকমটা ভেবে নিয়েই শৃঙ্গের পথে পা বাড়ান আরোহীরা। কোনও যুক্তি, ক্লান্তি, অভিজ্ঞতা কিছুই দাঁড়াতে পারে না ওই জেদের সামনে।”
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মিংমা জানান, আট হাজার মিটারের একটা শৃঙ্গ জয় করার পর শারীরিক ক্লান্তি তো আসেই, সেই সঙ্গে মস্তিষ্কও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। “সাধারণ ভাবে মস্তিষ্ক যতটা কাজ করতে পারে, এ রকম একটা বড় ধকল নেওয়ার পরে তার ৬০ শতাংশও করতে পারে না। ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই বিপদের আশঙ্কা বুঝতেও সমস্যা হয় সে সময়।” বললেন তিনি। এই সময় এক জন আরোহীর কাছে আরও বেশি জরুরি হয়ে ওঠেন তাঁর সঙ্গী শেরপা। পাহাড়ে অনেকটা বেশি সুস্থ থাকার দরুণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে শেরপাদের। বিপদের আশঙ্কাও আগাম আঁচ করতে পারেন।
তবে শেরপাদের হাত-পা বাঁধা। আরোহী যতটা পর্যন্ত যেতে চাইবেন, তত দূর সঙ্গে যেতে বাধ্য এক জন শেরপা। টাকার বিনিময়ে সে রকমই চুক্তি তাঁর সঙ্গে আরোহীর। তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাধারণত শেরপার হাতেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেন আরোহীরা। ছন্দার ক্ষেত্রেও যেমন দু’বার তাশি ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। এক বার দড়ি ফুরিয়ে যাওয়ার সময়, আর এক বার আবহাওয়া খারাপ হতে দেখে। প্রথম বার কথা শোনেননি ছন্দা। দ্বিতীয় বার শুনলেও শেষ রক্ষা হয়নি।
ছন্দাদের দুর্ঘটনা সম্পর্কে যতটা তথ্য জেনেছেন, তাতে কোনও খটকা লাগেনি মিংমার। বললেন, “পাহাড়ে শত্রুও আপন হয়। একই দড়িতে চলার সময় সাবধান হওয়াটা সবারই দায়িত্ব। নিজের জন্যও, অন্যের জন্যও। তাশি অসহায় ছিল ওই পরিস্থিতিতে।” মিংমার বক্তব্য, ছন্দার সঙ্গে নিখোঁজ হওয়া দাওয়া ও তেমবা ছিল তাশির নিজের ভাইপো-ভাগ্নে। ফলে অন্য কোনও ভাবনা আসছে না মিংমার মাথায়।
ছন্দাদের অভিযানের ব্যবস্থাপক হিসেবে যতটা সম্ভব সাবধানতা নিয়েছিলেন মিংমা। বললেন, “শেরপাদের জন্য বিমা করিয়েছিলাম। এমনকী রাজীব ও ছন্দার জন্যও বিমা করিয়ে দিই।” মিংমার দাবি, দাওয়া এবং তেমবার জন্য বিশেষ উদ্ধার-বিমাও ছিল। মিংমা জানালেন, অভিযানের আগে শেরপাদের উদ্ধার-বিমা করানোটা বাধ্যতামূলক। সেই বিমার সুবাদেই দুর্ঘটনার পরের দিন, ২২ তারিখ হেলিকপ্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় কপ্টার পৌঁছতে পারেনি।
মিংমা বললেন, “রাজীব আর ছন্দার বিমা ছিল না। আমি নিজের দায়িত্বে করিয়ে দিয়েছিলাম।” মিংমা জানালেন, আসলে এ ধরনের দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য চট করে বিমা মেলে না। তা-ও কাঞ্চনজঙ্ঘা ও ইয়ালুং কাং-এর মতো বিপদসঙ্কুল শৃঙ্গের কথা ভেবে রাজীব ও ছন্দার জন্য বিমা করিয়েছিলেন তিনি।
অভিযানের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয়, তার অনেকটাই যায় নেপাল সরকারের রয়্যালটি খাতে। মিংমা জানালেন, সরকার শুধু অনুমোদন দেয় শৃঙ্গ আরোহণের। আর সরকারি ভাবে এক জন লিয়াজোঁ অফিসারকে পাঠান অভিযাত্রী দলের সঙ্গে। বেসক্যাম্পে থাকার কথা তাঁর। দলের সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় করা, কেউ পাহাড় নোংরা করছেন কি না দেখা, শৃঙ্গজয়ের খবর বা কোনও দুর্ঘটনার খবর নীচে পৌঁছনোর মতো কাজগুলি করার জন্যই তিনি দলের সঙ্গে থাকেন। তবে ওই পর্যন্তই। মিংমার দাবি, ওই লিয়াজোঁ অফিসার নিজের দায়িত্ব পালন করছেন কি না, সে ব্যাপারে সরকার কোনও নজরদারি করে না! এমনকী দায়িত্ব পালন না করলে কোনও শাস্তিও হয় না! মিংমাই জানালেন, ছন্দাদের অভিযানের ক্ষেত্রেও এটাই হয়েছিল। সরকারি লিয়াজোঁ অফিসার কমলা গিরি অভিযাত্রী দলের সঙ্গে বেসক্যাম্প পর্যন্ত যানইনি।
কী ভাবে মেলে সরকারি অনুমতি?
কয়েক মাস আগে থেকেই অভিযানের পরিকল্পনা জানিয়ে আবেদন ও টাকা পাঠাতে হয়। শৃঙ্গের উচ্চতা, কতটা দুর্গম, সেই অনুযায়ী টাকার পরিমাণ কম-বেশি হয়। যেমন এভারেস্টের ক্ষেত্রে এক জনের খরচ ১০ হাজার ডলার। সেটাই কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষেত্রে দেড় হাজার ডলারের বেশি নয়! এক সঙ্গে একাধিক শৃঙ্গের জন্য আবেদন করলে সেই অনুমতিও পাওয়া যায়। বলাই বাহুল্য, টাকা বেশি লাগে সে ক্ষেত্রে।
কিন্তু এ রকম অবাধ অনুমতি দানে রাশ টানা উচিত নয় কি? অভিযাত্রীরা তো আবেগ ও জেদের বশে না-ই বুঝতে পারেন নিজের ক্ষমতা। মিংমা জানালেন, অভিযাত্রীদের সুবিধার্থেই এমন নিয়ম। অনেক অভিযাত্রীই এক সঙ্গে দু’টি বা তিনটি শৃঙ্গ জয় করতে চান। বারেবারে আসার খরচ আর সময় বাঁচানোর জন্য। ছন্দা নিজেও গত বছর এভারেস্ট আর লোৎসে জয় করেছিলেন একই অভিযানে। বিদেশিরা তো এ রকম করেই থাকেন। মিংমা বললেন, “আমি নিজেও ২০১০ এ এক সঙ্গে চারটি শৃঙ্গ চড়েছিলাম তিন মাসের মধ্যে।” সেই সঙ্গেই মিংমা জানালেন, সব সময় এই ধকলটা নেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে।
বহু দুর্ঘটনার উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছেন মিংমা। ছন্দাদের উদ্ধার অভিযান প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, উজ্জ্বলবাবুরা যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ কথা বলবে প্রকৃতিই। আবহাওয়া পরিষ্কার না থাকলে ‘গ্রাউন্ড সার্চ’ শুরু করা সম্ভব নয়। যেমন কিছুই করা যায়নি আজ।
এ বছর এভারেস্টের খুম্বু আইসফলে দুর্ঘটনায় ১৩ জন শেরপা মারা যাওয়া এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে দু’জনের নিখোঁজ হওয়ার পর এমনিতেই একটু থম মেরে রয়েছে শেরপা গোষ্ঠী। তার পর উদ্ধারকাজে ঝুঁকি নিতে গিয়ে যদি ফের কোনও বিপদ ঘটে, তা হলে অভিযান সংক্রান্ত সমস্ত পরিকাঠামোই ভেঙে পড়বে বলে জানালেন মিংমা।