গুয়াহাটি আদালতের পথে ধৃত জেএমবি জঙ্গি শাহনুর আলম। শনিবার উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গেড়ে থাকা জঙ্গিদের হাতে নিয়মিত টাকা পৌঁছে দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত শাহনুর আলম ওরফে ডাক্তার এ বার পুলিশের জালে। শুক্রবার বিকেলে অসমের নলবাড়ি জেলার মুকালমুয়া এলাকার লারকুচি গ্রাম থেকে শাহনুর আলম গ্রেফতার হওয়ার পর গোয়েন্দাদের আশা, জঙ্গিদের বিপুল টাকার উৎস-রহস্য উন্মোচনে এ বার এগোনো যাবে।
খাগড়াগড়-কাণ্ডে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) শাহনুরের জন্য ৫ লক্ষ টাকার ইনাম ঘোষণা করেছিল। শাহনুরকে অবশ্য গ্রেফতার করেছে অসম পুলিশ। শনিবার কামরূপ মহানগরের সিজেএম আদালত শাহনুরকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এনআইএ-র এক কর্তা এ দিন বলেন, “খাগড়াগড়ের তদন্তে শাহনুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গিদের জন্য টাকা জোগাড় ও বিলি-বণ্টনের দায়িত্ব ছিল তার উপর। কোথা থেকে কারা ওই টাকা পাঠাত, শাহনুরকে জেরা করে এ ব্যাপারে তথ্য মিলতে পারে।” ওই অফিসার জানান, অসম পুলিশের হেফাজত থেকে শাহনুরকে এনআইএ হেফাজতে নেওয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শীঘ্রই তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। খাগড়াগড়ের জঙ্গিদের আর্থিক উৎস সন্ধানে মামলা রুজু করে তদন্তে নামা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর গোয়েন্দারাও শাহনুরকে জেরা করবেন।
বর্ধমানে বিস্ফোরণের পিছনে সারদার টাকা খরচ হয়েছে বলে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ গত ৩০ নভেম্বর কলকাতার জনসভায় দাঁড়িয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। অমিত শাহ ওই দিন দাবি করেন, “খাগড়াগড় কাণ্ডের এনআইএ তদন্ত এবং সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত একই সময় এক মোড়ে গিয়ে মিলবে।” গোয়েন্দারা বলছেন, এ বিষয়ে তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য আহমেদ হাসান ইমরান যেমন গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র, তেমনই আর এক জন এই শাহনুর।
খাগড়াগড়ের জঙ্গিদের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়ার প্রধান সন্দেহভাজন শাহনুর আলম গ্রেফতার হওয়ার পর এ দিন বসিরহাটের বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রে প্রমাণিত, এই রাজ্য কী ভাবে জেহাদি কার্যকলাপ, জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও মারণাস্ত্র তৈরির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে বিপুল টাকার জোগান না থাকলে এমনটা হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।” তাঁর মতে, শাহনুর আলম গ্রেফতার হওয়ার পর এ বার খাগড়াগড়-কাণ্ডে এমন সব তথ্য উঠে আসবে, যা হতবাক করে দেবে রাজ্যের শাসক, বিরোধী সবাইকে। শমীকবাবুর কথায়, “কোন বাধ্যবাধকতা থেকে সিমি-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরানকে রাজ্যের মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তৃণমূল রাজ্যসভায় পাঠাল, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।”
তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানকে মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি বলেন, “আমি এখন মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলছি।” পরে বার বার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও ফোন বহু বার বেজে গিয়েছে। এসএমএমের জবাব দেননি তিনিও।
প্রাথমিক তদন্তে গোয়েন্দারা জেনেছেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা অসম হয়ে শাহনুর মারফত মুর্শিদাবাদের লালগোলা, বেলডাঙা এবং বর্ধমানের শিমুলিয়া ও খাগড়াগড়ের মতো জঙ্গি ডেরায় পৌঁছে যেত। শাহনুরের বাড়ি বরপেটা জেলার চটলা গ্রামে। তদন্তকারীদের দাবি, বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা থেকে ধুবুরি হয়ে এক ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় অন্তর টাকা নিয়ে বরপেটায় শাহনুরের কাছে পৌঁছত। তাকে সঙ্গে নিয়েই শাহনুর পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গি ডেরাগুলিতে ওই টাকা পৌঁছে দিয়ে আসত। জঙ্গি ডেরা বলে চিহ্নিত বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র শাহনুর গত দু’বছরে বহু বার এই ভাবে বরপেটা থেকে পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গিদের কাছে টাকা পৌঁছে দিয়ে এসেছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন।
এনআইএ-র এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “জঙ্গি মডিউল তৈরি ও কার্যকলাপের ক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যোগসূত্রের মাধ্যম ছিল শাহনুর।” তদন্তকারীরা জেনেছেন, অসম থেকে বহু তরুণ-তরুণীকে শাহনুর পশ্চিমবঙ্গের শিমুলিয়া ও মকিমনগরের জঙ্গি ঘাঁটিতে জেহাদি প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিল। শাহনুরের স্ত্রী সুজানা বিবিও ছিল মহিলা জঙ্গিদের প্রশিক্ষক।
খাগড়াগড়-কাণ্ডে এর আগে যারা ধরা পড়েছে তাদের কেউ বিস্ফোরক বা বোমা বিশেষজ্ঞ, কেউ বোমা ও রকেট লঞ্চারের কারিগর, কেউ বিস্ফোরক ও রাসায়নিক সরবরাহকারী। কেউ জেহাদি ভাবধারার প্রচারক বা জঙ্গি সংগঠনের চাঁই। কিন্তু খাগড়াগড়ে হদিস মেলা জঙ্গিদের অর্থ সরবরাহে প্রধান ভূমিকা ছিল শাহনুরের।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল অসমের মোট ১৪টি লোকসভা আসনের মধ্যে বরপেটা-সহ ১২টি কেন্দ্রে প্রার্থী দাঁড় করায়। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসমে নির্বাচনী প্রচারে গিয়েছিলেন। গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের খবর, অসমে তৃণমূলের রাজনৈতিক যোগাযোগের একাংশ ও শাহনুরের কয়েক জন পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মিলে যাচ্ছে। খাগড়াগড়-কাণ্ডে তার খোঁজে তল্লাশি শুরু হওয়া ইস্তক শাহনুর একাধিক বার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছিল। শাহনুরের পরিচিত রাজনীতিকরাই পুলিশ আসার খবর তাকে আগাম দিয়ে পালাতে সাহায্য করেছিল বলে পুলিশ জেনেছে।
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পালিয়ে বেড়ানো শাহনুর কী ভাবে গ্রেফতার হল?
অসম পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ সূত্রে জানানো হয়, শাহনুরের বন্ধু তথা ২০০১-এ আত্মসমর্পণ করা হরকত-উল-মুজাহিদিন জঙ্গি মুজিবর রহমানের সাহায্যেই শাহনুরকে ধরা হয়েছে। লারকুচি গ্রামের বাসিন্দা মুজিবরের কথায়, “শাহনুর আমাকে জানায়, লারকুচিতে কিছু দিন আশ্রয় নিয়ে সে বাংলাদেশ পালাবে। তবে পুলিশও লারকুচিতে শাহনুরের আসার কথা জেনে গিয়েছিল।” মুজিবরের বক্তব্য, “পুলিশকে বলি, শাহনুরকে মারবেন না। আমি তাকে আত্মসমর্পণ করাব। শাহানুরকে বোঝাই, এ ভাবে পালিয়ে বাঁচা যাবে না।” মুজিবর জানান, শুক্রবার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি চর এলাকা থেকে নৌকায় শাহনুর লারকুচি আসে। তাঁর কথায় “পুলিশকে জানাই। আমার বাড়ি থেকেই পুলিশ শাহনুরকে নিয়ে যায়।”
পুলিশের দাবি, লারকুচি গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয় শাহনুর। তিন-চার দিন নজরে রাখার পরে, শুক্রবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আদালতে শাহনুর দাবি করেন, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। অসম পুলিশের ডিজি খগেন শর্মা বলেন, “শাহনুর আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিল কি না, তা বড় কথা নয়। মোস্ট ওয়ান্টেড এই জঙ্গিকে গ্রেফতারই করেছি।” ডিআইজি (এসবি) হীরেন নাথের বক্তব্য, “লারকুচি গ্রাম জঙ্গিদের আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। এ বছরই জেএমবি-র কয়েক জন নেতা সেখানে এসেছিল। শাহনুরের জন্য ওই গ্রামের উপর আমাদের নজর ছিলই।”
খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্ত নিয়ে এ দিন অসন্তোষ প্রকাশ করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। শিলিগুড়ির নকশালবাড়িতে সিপিএমের জেলা সম্মেলনের জনসভায় তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী, অমিত শাহ বড় বড় কথা বলছেন। ভেবেছিলাম পর্বত প্রমাণ কিছু হবে। অথচ হচ্ছে শুধুই মূষিক প্রসব।” সূর্যকান্তবাবুর কথায় তদন্ত যে ভাবে হচ্ছে, তাতে কেন্দ্র-রাজ্য আঁতাঁত নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।