জলে ডুবে এলাকা, ফোন বন্ধ সাংসদের

বিষ্ণুপুরের সাংসদ সাঁতরে পৌঁছে যাচ্ছেন জলবন্দি এলাকায়। এমনকী, এলাকায় গিয়ে দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেছেন শাসকদলের সদা ব্যস্ত ‘স্টার’ সাংসদ দেবও। অথচ গত দু’সপ্তাহ ধরে বন্যা প্লাবিত বীরভূমে পা পড়েনি জেলার দুই সাংসদেরই। এক জন রয়েছেন লোকসভায়। দ্বিতীয় জনের মোবাইল ফোনই বন্ধ! বিপদের দিনে এলাকার সাংসদকে না পেয়ে তাই চরম ক্ষুব্ধ জেলার দুর্গত মানুষেরা। সুযোগ বুঝে গরহাজির তৃণমূল সাংসদ অনুপম হাজরা এবং শতাব্দী রায়ের সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীরাও।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ ও অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫৫
Share:

এখনও জলে ডুবে জেলার বিস্তীর্ণ ধানখেত। মঙ্গলবার সকালে মুরারই এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

বিষ্ণুপুরের সাংসদ সাঁতরে পৌঁছে যাচ্ছেন জলবন্দি এলাকায়। এমনকী, এলাকায় গিয়ে দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেছেন শাসকদলের সদা ব্যস্ত ‘স্টার’ সাংসদ দেবও। অথচ গত দু’সপ্তাহ ধরে বন্যা প্লাবিত বীরভূমে পা পড়েনি জেলার দুই সাংসদেরই। এক জন রয়েছেন লোকসভায়। দ্বিতীয় জনের মোবাইল ফোনই বন্ধ!
বিপদের দিনে এলাকার সাংসদকে না পেয়ে তাই চরম ক্ষুব্ধ জেলার দুর্গত মানুষেরা। সুযোগ বুঝে গরহাজির তৃণমূল সাংসদ অনুপম হাজরা এবং শতাব্দী রায়ের সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীরাও।
ঘটনা হল, অতিবৃষ্টির জেরে জেলার তিন মহকুমার বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। পাঁচ হাজারেরও বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ বন্যা দুর্গত হয়েছেন। ১৯টির মধ্যে ১৬টি ব্লকেই চাষে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে অনুপমের সাংসদ এলাকায়। বীরভূমের পাশাপাশি তাঁর সাংসদ এলাকায় থাকা বর্ধমানের আউশগ্রাম ২ ব্লকের বহু এলাকা বন্যা কবলিত। কিন্তু, দুই জেলার বহু জায়গাতেই ত্রাণ নিয়ে প্রশাসনের ভূমিকা সন্তোষজনক নয় বলে দুর্গতদের অভিযোগ।
লাভপুরেই যেমন ১১ দিন আগে কুঁয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে পড়ে প্রায় ৫০টি গ্রাম। ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ বন্যা দুর্গত হন। বাড়িঘর ভেঙে ওই সব বন্যা দুর্গতদের দিন কাটছে অস্থায়ী ত্রাণ শিবির কিংবা নদীবাঁধের উপর ত্রিপলের ছাউনির নীচে। অনেকে ত্রিপলও পাননি। ভেঙে পড়া বাড়ির বাঁশ-বাতা ছাড়িয়ে তালাই কিংবা চট দিয়ে তৈরি করে নিয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। তিন দিনের মাথায় অধিকাংশ ত্রাণ শিবিরেরই খাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলেও অভিযোগ।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। এলাকার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা অন্তত তেমনটাই বলে। গত লোকসভা ভোটের প্রচারে কার্যত নিজেদের এলাকা চষে ফেলেছিলেন অনুপম এবং শতাব্দী। সদর লাভপুর থেকে বন্যা কবলিত থিবা পঞ্চায়েত এলাকায় বহু কর্মি ও পথসভা করেছিলেন অনুপম। প্রতিটি সভাতেই তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘এত দিন আপনারা যাঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন, তাঁকে আর জেতার পরে দেখতে পাননি। আমি জিতলে বারবার আপনাদের কাছে আসব। সব সময় আপনাদের পাশে থাকব।’’

Advertisement

বারবার দূরের কথা ভোটে জেতার পর থেকে ধোপদুরস্ত সাদা পায়জামা আর সবুজ পাঞ্জাবির সেই সৌম্য দর্শন যুবকটিকে আর দেখেননি শীতলগ্রামের ডাগর বাজিকর, কবীর থান্দার, থিবার ভগীরথ ধীবর, প্রবীর বাগদি কিংবা গোকুলবাটির শ্যামল মেটে, বাবলু সূত্রধরেরা। তাঁদের ক্ষোভ, ‘‘এখনও গ্রামের বহু জায়গায় অনুপম হাজরার দেওয়াল লিখন রয়েছে। গ্রামের মোড়ে সে দিনের সভায় অনুপমবাবুর বক্তব্য আজও স্পষ্ট মনে আছে। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন। ১০ দিন ধরে জলবন্দি। তাঁর টিকিরও দেখা পাইনি।’’ আর কত বড় বিপদ হলে সাংসদকে পাশে পাওয়া যাবে, প্রশ্নই তুলছেন লাভপুরের মানুষ।

এ দিকে, সাসংদ শতাব্দীকে না পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে রামপুরহাট মহকুমার দুর্গত এলাকাও। নলহাটি থানার টিঠিডাঙা গ্রামের মলুদা বেওয়া, বদিরুল আলম, ইন্দ্রজিৎ বাগদিদের ক্ষোভ, ভোটের সময় এলাকায় এসে সাংসদ নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, এখন এলাকার মানুষ যখন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে দিন কাটাচ্ছেন, তখনই তাঁর দেখা নেই। মাড়গ্রাম থানার বাতিনা গ্রামের সৌমেন মণ্ডল, শ্যামল মালরা আবার বলছেন, ‘‘তারপোলিনের অভাবে এলাকার মানুষকে খোলা আকাশের নীচে বাস করতে হচ্ছে। এলাকার বেশির ভাগ জমিই জলের তলায়। কী ভাবে দিন কাটবে আমরা কূল পাচ্ছি না। অথচ সাংসদকে যখন সব থেকে বেশি করে পাশে দরকার ছিল, তখনই তাঁর খোঁজ নেই।’’ শতাব্দীর বিরুদ্ধে একই রকম ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে রামপুরহাট থানার দেবগ্রাম, নাছিয়ার মতো এলাকাও। সেখানকার বাসিন্দা গণেশচন্দ্র মণ্ডল, খাইরুল আলম, গোলাম মহম্মদরা জানান, পাড় ভেঙে গ্রাম ক্রমশ নদী গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রাস্তা ডুবে আছে, পানীয় জল নেই। শুধু সাংসদ কেন, প্রশাসনও তেমন ভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছে না বলে তাঁদের অভিযোগ।

Advertisement

অনুপম যদিও তাঁর এই ‘অনুপস্থিতি’র একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘এই মুহুর্তে সাংসদ সাসপেন্ড নিয়ে লোকসভায় একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই দলীয় নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে আমাকে দিল্লিতে থেকে যেতে হয়েছে।’’ তবে, প্রতি মুহূর্তে এলাকার বন্যা পরিস্থিতির খবর নিচ্ছেন বলে তিনি দাবি করেছেন। তবে, তৃণমূলের তরুণ সাংসদ যে ‘পরিস্থিতি’র ধুয়ো তুলেছেন, তার তৈরি হয়েছে অতি সম্প্রতি ‌(‌সোমবার)। তার আগে সাসংসদেরা এক বারও আসার সুযোগ পাননি, তা মানতে রাজি নয় বিরোধীরা। অন্য দিকে, ফোন বন্ধ থাকায় শতাব্দীর সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে শাসকদলের দুই সাংসদকে খোঁচা মারতে ছাড়ছে না বিরোধী দলগুলি। বোলপুর ও বীরভূম, দুই লোকসভা কেন্দ্রেরই প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম বলছেন, ‘‘আমরা জানি, সব সময় এক জন সাংসদের পক্ষে সব জায়গায় পৌঁছনো সম্ভব হয় না। কিন্তু, বিপদে-আপদে আমরা মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আসলে মুখে বলা আর কাজে করা, এক কথা নয়। তৃণমূলের সবই তো মুখ সর্বস্ব।’’ অন্য দিকে, বিজেপি-র জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহার কটাক্ষ, ‘‘২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা বন্যা দুর্গতদের কপট দরদ দেখাতে জেলায় জেলায় ছুটছেন। অথচ এই চরম পরিস্থতিতে এলাকার সাংসদেরাই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন!’’

বিপর্যয়ের সময় সাংসদকে এলাকায় যেতেই হবে, এমন যুক্তি মানতে নারাজ জেলা তৃণমূল। রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সাংসদকে এলাকায় যেতেই হবে, এই দাবি ঠিক নয়। আমাদের দুই সাংসদ লোকসভা অধিবেশনে রয়েছেন। সেখানে থাকাটাও জরুরি কাজ।’’ তাঁর দাবি, সাংসদেরা প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতির খোঁজ নিচ্ছেন। দুর্গত এলাকার জন্য প্রশাসন সব রকম সাহায্য করছে। দলও মানুষের পাশে রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন