ট্রেনে পিছু, প্ল্যাটফর্মে মহিলাকে অ্যাসিড ছুড়ে চম্পট

এনআরএসের শয্যায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন যে মহিলা, তিনি ধানবাদের সোনালি মুখোপাধ্যায়ের নাম শোনেননি। কিন্তু, এগারো বছর আগে সোনালি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন, সেটাই আজ অনুভব করছেন নদিয়ার রানাঘাটের বছর আটত্রিশের ওই মহিলা। মুখে, গলায় আর হাতে অ্যাসিডের দগদগে ঘা। ঠিক যেমন সোনালির। দেশের বিভিন্ন অংশে মহিলাদের উপরে অ্যাসিড হানার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই অ্যাসিড বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে।

Advertisement

সুশান্ত বণিক ও সৌমিত্র শিকদার

আসানসোল ও রানাঘাট শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৪ ০৩:৫৩
Share:

অ্যাসিডে আক্রান্ত মহিলা। ছবি: শৈলেন সরকার।

এনআরএসের শয্যায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন যে মহিলা, তিনি ধানবাদের সোনালি মুখোপাধ্যায়ের নাম শোনেননি।

Advertisement

কিন্তু, এগারো বছর আগে সোনালি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন, সেটাই আজ অনুভব করছেন নদিয়ার রানাঘাটের বছর আটত্রিশের ওই মহিলা। মুখে, গলায় আর হাতে অ্যাসিডের দগদগে ঘা। ঠিক যেমন সোনালির।

দেশের বিভিন্ন অংশে মহিলাদের উপরে অ্যাসিড হানার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই অ্যাসিড বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে। তার পরেও যে এমন ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না, মঙ্গলবার রাতে আসানসোলের চিত্তরঞ্জন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রানাঘাটের ওই মহিলার উপরে অ্যাসিড আক্রমণ থেকেই তা স্পষ্ট। অভিযোগ, ট্রেন থেকেই ওই মহিলার পিছু নিয়েছিল তাঁর এক সময়কার পড়শি রিপন দাস। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের আলো-আধাঁরিতে চেনা মুখটা দেখতে পেয়েই জোর কদমে হাঁটা শুরু করেছিলেন ওই মহিলা। কিন্তু, নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। রিপনের ছোড়া অ্যাসিডে গুরুতর আহত হয়ে প্ল্যাটফর্মের এক কোণেই জ্ঞান হারান। পরে অন্য যাত্রীরা এবং রেলপুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যান ওই মহিলাকে।

Advertisement

পুলিশের কাছে রানাঘাটের হবিবপুর গ্রামের আঠেরোর পাড়ার বাসিন্দা রিপনের নামে অভিযোগ দায়ের করেছেন ওই মহিলা। চিত্তরঞ্জন রেলপুলিশের এক অফিসার বলেন, “আমরা সমস্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছি। অভিযুক্তের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে।” মহিলার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বুধবার বিকেলে তাঁকে চিত্তরঞ্জনে রেলের কস্তুরবা গাঁধী হাসপাতাল থেকে কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। রাত ৯টা নাগাদ এনআরএসে পৌঁছতেই ওই মহিলাকে হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রের খবর, মহিলার মুখের ডান দিক সম্পুর্ণ পুড়ে গিয়েছে। চোখ দু’টি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি দেখতে পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন চিকিৎসকেরা।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, রিপনের বাড়ি যেখানে, তার থেকে কিছুটা দূরেই বর্তমানে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন বিবাহ-বিচ্ছিন্না ওই মহিলা। তাঁর বছর কুড়ির একটি ছেলে আছে। পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি রিপনের সঙ্গে ওই মহিলার পরিচিতি অনেক দিনের। একটা সময় দু’জনই আঠেরোর পাড়ায় থেকেছেন। রিপনও বিবাহিত। ওই মহিলার সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক আছে, এই সন্দেহে বছর পাঁচেক আগে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে রিপনের স্ত্রী কল্যাণীতে বাপের বাড়িতে চলে যান। সম্প্রতি কলকাতার এক আয়া সেন্টারের মাধ্যমে আসানসোলের রূপনারায়ণপুরের বাসিন্দা, বারাবনির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সুধীররঞ্জন দাসের বাড়িতে আয়ার কাজ নিয়েছিলেন ওই মহিলা।

বুধবার হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ওই মহিলা জানান, দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে তিনি রানাঘাটে মায়ের কাছে গিয়েছিলেন। মঙ্গলবার শিয়ালদহ-বালিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে চিত্তরঞ্জন স্টেশনে নামেন তিনি। তাঁর কথায়, “ট্রেন থেকে নেমেই রিপনকে দেখতে পেয়েছিলাম। তখনই বুঝেছি, কিছু একটা ঘটাবে। বিপদ বুঝে জোরে হাঁটতে শুরু করি। কিন্তু কয়েক পা যাওয়ার পরেই আমার মুখে ও অ্যাসিড ছুড়ে মারে।” তাঁর অভিযোগ, রিপন বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও বারবার তাঁকে কুপ্রস্তাব দিত। এমনকী, রানাঘাটে পাড়ার ক্লাবে একাধিক বার

উভয় পক্ষকে বসিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। মাস তিনেক আগে রানাঘাট থানায় রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করেছিলেন ওই মহিলা।

রিপনের কথা জানতেন প্রাক্তন বিধায়কের বাড়ির সদস্যেরাও। তাঁদের অন্যতম হরিনারায়ণ দাস বলেন, “আমাদের বাড়ির পরিচারিকাকে যে এক জন উত্ত্যক্ত করত, সে কথা আমরা জানতাম। কিন্তু, ওই যুবক যে এতটা বেপরোয়া হয়ে চিত্তরঞ্জনে এসে এমন কাণ্ড করবে, তা ভাবতে পারিনি!” তিনি জানান, মঙ্গলবার বাড়ি থেকে বেরিয়েই ওই মহিলা তাঁকে ফোন করে স্টেশনে নিতে আসতে বলেন। “স্টেশনে জটলা দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখি, মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন ওই পরিচারিকা।”বলছিলেন হরিনারায়ণবাবু।

বুধবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে মহিলার সঙ্গে কথা বলে চিত্তরঞ্জন জিআরপি। চিত্তরঞ্জন লাগোয়া, ঝাড়খণ্ডের জামতারার এসডিও অখিলেশ সিংহও এ দিন আক্রান্তের সঙ্গে দেখা করে সব রকমের প্রশাসনিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। বিকেলে হাসপাতাল

থেকে মাকে নিয়ে যেতে আসেন ওই মহিলার ছেলে। তিনিও জানান, মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে দাদু-দিদার কাছে থাকেন তিনি। রিপন সাত-আট বছর ধরেই তাঁর মাকে উত্ত্যক্ত করত। এক বার তাঁর বাড়িতে ঢুকে দাদু-দিদা ও মাকে রিপন মারধর করে বলেও অভিযোগ ওই যুবকের।

যদিও রিপনের মা অন্নদা দাস এ দিন দাবি করেন, “আমার ছেলের সঙ্গে ওই মেয়েটির অনেক দিনের সম্পর্ক। সম্প্রতি ওই মেয়েটি সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ছেলে মাথা গরম করত এই নিয়ে। মঙ্গলবার বহরমপুরে যাচ্ছে বলে বেরিয়ে যায় ছেলে।

তার পর রাতে শুনি এই সব ঘটনা।” রিপন একন কোথায়, তা তিনি জানেন না বলেও দাবি অন্নদাদেবীর। হবিবপুর পঞ্চায়েতের প্রধান শান্তি পার্শী বলেন, “ওদের সম্পর্কের কথা গ্রামের সকলেই জানত। কিন্তু, রিপন হঠাৎ এমন কাণ্ড কেন ঘটাল, বুঝতে পারছি না।”

বোঝা যায়ও না। ধানবাদের সোনালিও যেমন কখনও বুঝতে পারেননি, কোন অপরাধে তাঁকে ওই চরম শাস্তি পেতে হল। ২০০৩ সালের এপ্রিলে এনসিসি-র কৃতী ক্যাডেট সোনালিকে অ্যাসিড ছুড়ে মারে তাঁরই পাড়ার তিন যুবক। কলেজের ছাত্র সংসদের সভাপতি সোনালি তখন সবে আঠারোয় পা দিয়েছেন। অ্যাসিডে ভয়ঙ্কর ভাবে পুড়ে গিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে প্রাণে বাঁচলেও জীবনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে তাঁর। অভিযুক্তদের নিম্ন আদালতে সাজা হলেও হাইকোর্ট তাদের জামিন দেয়। এক সাক্ষাৎকারে সোনালির বাবা আক্ষেপ করেছিলেন, “অ্যাসিড আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আইন আরও কঠোর হওয়া দরকার। না হলে আরও অনেক সোনালি পাবে এই দেশ!”

চিত্তরঞ্জন স্টেশনের ঘটনা কি সে কথাই জানান দিচ্ছে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন