পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র দু’টি ৬০০ মেগাওয়াট ইউনিট তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেলেও জমি-জটে জলের লাইন বসানো যায়নি। ফলে শুরু করা যায়নি বিদ্যুৎ উৎপাদন। প্রথম পর্যায়ের কাজ অসমাপ্ত থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে হাত দেওয়ায় ডিভিসি কর্তৃপক্ষের উপরে বেজায় অসন্তুষ্ট ছিল কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রক। এই পরিস্থিতিতে গোটা প্রকল্পের হালহকিকত খতিয়ে দেখে এনটিপিসি-কে রিপোর্ট দিতে বলেছে কেন্দ্র। ওই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কী হবে, মূলত সেই বিষয়েই রিপোর্ট দেবে এনটিপিসি।
ঝাড়খণ্ডের বোকারোতেও ডিভিসি ৫০০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ছে। সেখানেও জমি-সহ নানা সমস্যায় প্রকল্পের কাজ ঢিমেতালে চলছে। একই ভাবে বোকারোর ইউনিটের দায়িত্বও তারা নিতে পারবে কি না, কেন্দ্র তা ভেবে দেখতে বলেছে এনটিপিসিকে। কারণ, বিদ্যুৎমন্ত্রক মনে করে, প্রকল্প নির্মাণে এনটিপিসির পেশাদারিত্ব তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। তারা ওই প্রকল্পগুলির দায়িত্ব নিলে জটিলতা কাটার সম্ভাবনা বেশি।
কেন্দ্রের এই পদক্ষেপে ডিভিসি কর্মীদের একাংশ ক্ষুব্ধ। সেখানকার একাধিক ইউনিয়নের অভিযোগ, বর্ধমানের কাটোয়া তো বটেই, আরও অনেক প্রকল্প হাতে নিয়ে নির্মাণের কাজ শুরুই করতে পারেনি এনটিপিসি। তা হলে কেন ডিভিসি-র নিজস্ব প্রকল্প তাদের হাতে দেওয়ার কথা ভাবছে কেন্দ্র? ইউনিয়নগুলির বক্তব্য, রঘুনাথপুর ও বোকারোয় জমিজটে কাজ আটকে। ডিভিসি কর্তৃপক্ষ কোনও ভাবে দায়ী নয়। কিন্তু বিদ্যুৎমন্ত্রকের বক্তব্য, প্রকল্প গড়তে জমি সমস্যার মেটাতে হবে ডিভিসিকেই। তারা সেই দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
মে মাসের শেষে ডিভিসির সব এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর দিল্লিতে ডেকে শেষ ছ’মাসের কাজকর্ম খতিয়ে দেখেন বিদ্যুৎমন্ত্রকের সচিব পি কে সিংহ। সেখানেই ডিভিসির বিভিন্ন নির্মীয়মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে কথা হয়। কেন নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে, কেনই বা কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বাধ্য হচ্ছে তারা, সে কথাই মন্ত্রককে বোঝানোর চেষ্টা করেন আর্থিক অনটনে জীর্ণ ওই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার অফিসাররা। কিন্তু ডিভিসির দেওয়া তথ্যে খুশি হতে পারেনি বিদ্যুৎমন্ত্রক। তাই ডিভিসি যে প্রকল্পগুলি হাতে নিয়েছে, সেগুলির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে এনটিপিসিকে। ডিভিসির এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর (প্রকল্প) দেবাশিস মিত্রও বলেন, “রুঘুনাথপুর ও বোকারোর বর্তমান পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবে এনটিপিসি।”
এনটিপিসির চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরীও বিদ্যুৎমন্ত্রকের প্রস্তাবের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “রঘুনাথপুর ও বোকারো দু’টি প্রকল্পই নানা সমস্যায় রয়েছে। সেখানকার বিদ্যুৎ বিক্রি নিয়ে চুক্তি হয়নি (পাওয়ার পার্চেজ এগ্রিমেন্ট)। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্প-খরচ বহু গুণ বেড়েছে। ফলে সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক ভাবে বেশি হওয়ারই কথা।” এই অবস্থায় কী ভাবে ডিভিসির পাশে দাঁড়ানো যেতে পারে, তা এনটিপিসির পরিচালন পর্ষদ ভেবে দেখবে বলে জানিয়েছেন অরূপবাবু।
ডিভিসির কর্মী-অফিসারদের একাংশ অবশ্য কেন্দ্রের এই প্রস্তাবে ভিন্ন গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ইতিমধ্যে ডিভিসির পরিচালন পর্ষদের একাংশ নিজেদের গ্রিড পশ্চিমবঙ্গের হাতে তুলে দিতে উদ্যোগী হয়েছে। এমনকী, সেচ ব্যবস্থা ও জলাধারগুলিরও পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। তাঁদের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন বকেয়া পড়ে থাকা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল ঝাড়খণ্ডের কাছ থেকে আদায় করতে পারছে না ডিভিসি। কেন্দ্রও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তার মধ্যে নানা পদক্ষেপ আসলে ডিভিসিকে ভেঙে দেওয়ারই চক্রান্ত, অভিযোগ ওই কর্মী-অফিসারদের।
এর প্রতিবাদে সমস্ত ইউনিয়ন এক ছাতার তলায় এসে ডিভিসি উন্নয়ন কমিটি তৈরি করেছে। কমিটির আহ্বায়ক দেবাশিস ঘোষের অভিযোগ, অদূর ভবিষ্যতে ডিভিসির বোকারো ও রঘুনাথপুর প্রকল্প এনটিপিসির হাতে দেওয়া হতে পারে। ডিভিসি সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেই সমস্যা মেটাতে বিদ্যুৎমন্ত্রককে এগিয়ে আসার দাবি তুলেছে উন্নয়ন কমিটি।