তৈবিচারা ছাড়িয়ে ‘ভাই’ ছুটছে বেজিংয়ের ট্র্যাকে

বড়দির পিছন পিছন সেই কোন ছোট বেলায় শুরু হয়েছিল তাঁর দৌড়। গ্রামের পুকুরপাড়, আলপথ, তৈবিচারা গ্রামের বাঁশঝাড়ে ঢাকা কাদা মাখা রাস্তা— পিছনে পড়ে থেকেছে।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

বেথুয়াডহরি শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০০
Share:

দেবশ্রী মজুমদারের সাথে কথা বলছেন দিদি শতাব্দী ও মা।—নিজস্ব চিত্র।

বড়দির পিছন পিছন সেই কোন ছোট বেলায় শুরু হয়েছিল তাঁর দৌড়। গ্রামের পুকুরপাড়, আলপথ, তৈবিচারা গ্রামের বাঁশঝাড়ে ঢাকা কাদা মাখা রাস্তা— পিছনে পড়ে থেকেছে।

Advertisement

শনিবার বেজিংয়ের ‘বার্ডস নেস্ট’-এর সিন্ডার ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে সেই ফেলে আসা গ্রামের কথা মনে পড়ছে দেবশ্রী মজুমদারের। বলছেন, ‘‘তৈবিচারার বাড়ি আর ওই কাদা ভরা রাস্তাটার কথা খুব মনে পড়ছে জানেন, দৌড়টা ওখান থেকেই শুরু করেছিলাম কিনা।’’

এ দিন কোন কাক-ভোরে টিভি খুলেছিলেন মা মেনকাদেবী। ৪x৪০০ মিটার রিলে রেসে মেয়ে দৌড়বে। বলছেন, ‘‘সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোর হতেই টিভি খুলে বসে গিয়েছি।’’ বাংলা থেকে দেশের এক মাত্র প্রতিনিধির বেথুয়াডহরির তৈবিচারা গ্রামের আটপৌরে গ্রামীণ ঘরে সে কী উত্তেজনা। এ দিনের দৌড়ে অবশ্য তেমন আহামরি ফল করতে পারেননি দেবশ্রীরা। ১৭ দেশের মধ্যে চতুর্দশতম স্থানে থেকে শেষ করেছেন তাঁরা। সময়, ৩ মিনিট ২৯ সেকেন্ড ০৮ মাইক্রো সেকেন্ড। মেয়ের দৌড়ের খুঁটিনাটি সব মনে থাকে মায়ের। বলছেন, ‘‘সময়টা একটু খারাপ হয়ে গেল, তবে দেখবেন পরের বার আরও ভাল করবে।’’

Advertisement

দেবশ্রীর গলাতেও সেই প্রত্যয়, ‘‘আমরা একটু পিছনে পড়ে গিয়েছি ঠিকই। তবে দেখবেন, এই তো শুরু। পরের মিটে আরও ভাল করব।’’ এই লড়াইটা তাঁকে শিখিয়ে গিয়েছেন বাবা মন্মথরঞ্জন মজুমদার।

আর কেউ না চিনুক নিজের ছোট মেয়েটিকে ঠিক চিনেছিলেন গ্রামের ডিপ-টিউবওয়েল অপারেটর মন্মথবাবু। গর্ব করে বলতেন, ‘‘দেখো, মেয়েটা এক দিন দৌড়ে অনেক দূর চলে যাবে।’’ তবে মেয়ের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি তিনি। মেনকাদেবী বলছেন, ‘‘মেয়ে যে গ্রামের সীমানা উজিয়ে বেজিংয়ের মাটিতে দৌড়বে মনে মনে এমন স্বপ্ন দেখলেও মানুষটা তা চোখে দেখে যেতে পারল না।’’ বছর কয়েক আগে আচমকাই মারা যান মন্মথবাবু।

বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন দেবশ্রী। দৌড় ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলতে শুরু করেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন মা। দিদিরা বলছেন, ‘‘সামলে নিতে সময় নেয়নি ‘ভাই’।’’ ব্যাখ্যাটা দিচ্ছেন তাঁর বড়দি, ‘‘চার বোনের মধ্যে ও ছোট, আমাদের কোনও ভাই নেই। তাই ছোট থেকে ওকেই আমরা ‘ভাই’ বলে ডাকি।’’

ছোটবেলা থেকে ডানপিটে দেবশ্রীর সমস্যা দেখা দিয়েছিল নবম শ্রেণিতে ওঠার পরে। গ্রামের তৈবিচারা অক্ষয় হাইস্কুলে পড়ত সে। কিছুতেই তাকে মেয়েদের পোশাক পরানো যেত না। কিন্তু স্কুলের নিয়ম, নবম শ্রেণীতে শাড়ি পড়ে স্কুলে যেতে হবে। তাঁর মা বলছেন, ‘‘হাত-পা ছুঁড়ে মেয়ে জানিয়ে দিল স্কুলে ও প্যান্ট পরেই যাবে। স্কুলে ঢোকার মুখে শাড়িটা জড়িয়ে নেবে শুধু। মেয়ের জেদের কাছে হার মানলাম সবাই।’’

সেই জেদই দেবশ্রীকে পৌঁছে দিয়েছে বেজিংয়ে। স্কুল থেকে জেলা, তারপর কলকাতার সাই ক্যাম্প। ২০১৪ সালে দেশের হয়ে দৌড় শুরু তাঁর। এশিয়ান গেমসে ৪x৪০০ মিটার রিলেতে সোনা, চলতি বছরে এশিয়ান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে রুপো পেয়েও কিছুতেই যেন খিদে মেটে না মেয়েটির। একে একে প্রায় কুড়িটা আন্তর্জাতিক মিটে যোগ দিয়েছেন তিনি। দিদিরা দেখাচ্ছেন, কমনওয়েলথ গেমসে উসেইন বোল্টের সঙ্গে বোনের ছবি। মেনকাদেবী বলছেন, ‘‘পদক নিয়ে বাবার সঙ্গে একটা ছবি তোলার খুব শখ ছিল মেয়ের। তা আর হল না।’’

বেজিংয়ের স্টেডিয়াম থেকে মেয়েও বলছেন, ‘‘দৌড়ের গল্পগুলো বাবার সঙ্গে করেই সব থেকে মজা পেতাম। বাবাকে খুব মিস করছি জানেন....।’’ গলা ধরে আসে দেবশ্রীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন