মুখ দেখালেই বিপদ। এটিআই বুথ থেকে বেরিয়ে আসছেন বহিরাগতরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
বোন এসেছিলেন ‘দাদা’র কাছে, ভাই এসেছেন ‘দাদা’র নির্দেশে।
শুক্রবার বিধাননগর পুর নির্বাচনে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে এমনই সব ভাই-বোনের সন্ধান মিলেছে। কেউ বা আবার নিজেকে সল্টলেকের বাসিন্দা জাহির করতে গিয়ে এমন ঠিকানা বলেছেন যে চমকে উঠেছেন সল্টলেকের আসল বাসিন্দারাই।
বেলা সাড়ে এগারোটায় বাগুইআটির অন্নদাসুন্দরী স্কুলের বুথ। দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন সাদা-কালো চেকের সালোয়ার-কামিজ পরা মোটাসোটা চেহারার এক মহিলা। এক বাম কর্মী ওই মহিলাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘সোমা সাহা। দুর্গানগর থেকে এসেছেন।’’ সাংবাদিকদের দেখে পাশের একটি দোকানে সেঁধিয়ে গেলেন সোমা। পরে ফোনে যোগাযোগ করতে বললেন, ‘‘আমি তো আজ বাগুইআটি যাইনি।’’
কিন্তু তা হলে ছবি এল কী করে? পর ক্ষণেই সোমা বললেন, ‘‘ওখানকার প্রার্থী মণীশ মুখোপাধ্যায় আমার দাদা। তাই গিয়েছিলাম।’’ দুর্গানগরের তৃণমূল কর্মীদের একাংশ অবশ্য বলছেন, সোমাকে কামদুনি কাণ্ডের পর সেখানকার মিছিলেও দেখা যায়। বহিরাগত এক মহিলার দেখা মিলেছে সল্টলেকের আইএ ব্লকে। তিনি অবশ্য লুকোছাপা করেননি। জিজ্ঞাসা করতেই হেসে বললেন, ‘‘খড়দহে থাকি। গত কাল রাতেই সল্টলেকে চলে এসেছিলাম।’’
এফই ব্লকের কমিউনিটি সেন্টারের ভোটকেন্দ্রের ভিতরে অবলীলায় পায়চারি করছিলেন এক যুবক। হাতে জ্বলছে সিগারেট। বুথে ঢুকছেন, বেরিয়েও আসছেন। নাম জিজ্ঞাসা করতে উত্তর এল, ‘‘পিন্টু দাস।’’ ‘আপনি কি সরকারি অফিসার?’ ফের উত্তর এল, ‘‘না। আমি টিঙ্কুদার লোক।’’ কে টিঙ্কুদা? জানা গেল, তিনি লেকটাউন এলাকার তৃণমূলের কাউন্সিলর। সল্টলেকে যেমন শিবম সানু নামে এক বহিরাগতকে পাকড়াও করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তিনি জানান, বেলেঘাটা থেকে কমলদা নামে এক নেতার কথায় এসেছেন তিনি। ‘‘ছাপ্পা ভোট দিতে পারলে ৫০০ টাকা পাব,’’ বলেন শিবম। স্থানীয় এক ‘দাদা’র হয়েই কাজ করতে এসেছিলেন নিউ ব্যারাকপুর পূর্বাচলের বাসিন্দা বিনয় দাস। বাগুইআটি ইয়ং সেন্টার ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তিনি। সাংবাদিক দেখেই তড়িঘড়ি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।
পরিচয় দিতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে বেফাঁস কথাও বলেছেন কেউ কেউ। যেমন এফডি ব্লক লাগোয়া এটিআই-এর সামনে এক যুবককে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতেই কিছু ক্ষণ থেমে বললেন, ‘‘আমি এস়ডি ব্লকে থাকি।’’ ওই নামে কোনও ব্লকের অস্তিত্বের কথা অবশ্য সল্টলেকের বাসিন্দা কিংবা প্রশাসনের জানা নেই। আর এক জন সন্দেহভাজন যুবককে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে উত্তর এল, ‘‘বাড়িতে থাকি।’’ বা়ড়ি কোথায়? ‘‘কেন বাড়িতেই।’’ অন্য এক জন হোমওয়ার্ক সেরে রেখেছিলেন। জিজ্ঞাসা করতেই বলেন, ‘‘এফডি-১৩ বাই ৮।’’
ভোট করতে আসা অনেক বহিরাগত বুক ফুলিয়ে ঘুরলেও নিজের নাম জানাতে চাননি। এটিআই-এ সাদা গেঞ্জি পরা এক যুবক দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সদর্পে ঘোষণাও করলেন, ‘‘ছাপ্পা দিচ্ছি। আরও দেব।’’ কোনও বহিরাগত আবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘নিজের চরকায় তেল দিন।’’ পূর্বাচলের একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের সামনে ষণ্ডা চেহারার এক যুবক অকুতোভয়ে বললেন, ‘‘ছাপ্পা দিতে এসেছি। আমাদের কোনও লজ্জা নেই। গত ৩৪ বছর ধরে এমনই তো চলেছে।’’ এফডি-এফই ব্লকের বিভিন্ন বুথে ঘুরে ঘুরে ভোট দিচ্ছিলেন সাদা শার্ট পরা মাঝবয়সি এক ব্যক্তি। সে কথা বুক ফুলিয়ে স্বীকারও করেছেন। ভোট দেওয়ার ফাঁকে ঘুরে ঘুরে পুলিশ ও বিরোধী দলের কর্মীদের গালাগাল এবং সাংবাদিকদের হুমকি দিতেও কসুর করেননি তিনি।