দক্ষিণের কড়চা

ভাঙা গড় আর একটি প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া মন্দির। দু’দিকে জঙ্গলের মাঝে উঁচু জমিতে এইটুকু মাত্র আছে। আর আছে স্থানীয়দের স্মৃতি। প্রায় চারশো বছর আগের এক রাজপরিবারের স্মৃতি, প্রবীণ থেকে নবীনে বয়ে চলা মৌখিক গল্পের মধ্য দিয়ে শুধু রাজত্বের স্মৃতি নয়, রাজত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরও স্মৃতি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০২
Share:

ভ্রমণ-পথ

Advertisement

বিপ্লবের রাজবাড়ি

ভাঙা গড় আর একটি প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া মন্দির। দু’দিকে জঙ্গলের মাঝে উঁচু জমিতে এইটুকু মাত্র আছে।

Advertisement

আর আছে স্থানীয়দের স্মৃতি। প্রায় চারশো বছর আগের এক রাজপরিবারের স্মৃতি, প্রবীণ থেকে নবীনে বয়ে চলা মৌখিক গল্পের মধ্য দিয়ে শুধু রাজত্বের স্মৃতি নয়, রাজত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরও স্মৃতি।

ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে বাঁকুড়ার রাইপুরের কাছে রসপাল রাজবংশ একদা জড়িয়েছিল সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে। বাংলার বিপ্লবীরা কলকাতা আর মেদিনীপুরের বাইরে যে সব জায়গায় গোপন আস্তানা তৈরি করেন, তার অন্যতম ছিল বাঁকুড়ার ছেঁদাপাথর। সেই বিপ্লবীদের নিয়মিত সাহায্য করতেন অম্বিকানগরের রাজা রাইচরণ ধবল আর রসপালের রাজা কালীপ্রসন্ন দেব। ১৯০৮-এ কৃষ্ণনগর ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে জবানবন্দি দেওয়ার সময়ে আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবী শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ জানান, ছেঁদাপাথরের প্রশিক্ষণ শিবিরে রসপাল রাজপরিবারের সদস্যেরা নিয়মিত যোগ দিতেন।

রাজবাড়ির যেটুকু ধ্বংসাবশেষ আজও আছে, তা থেকেও এই অনুমান করা যায়। পশ্চিমদিকের অন্দরমহলের সঙ্গে দু’টি গোপন কক্ষ পরবর্তী কালে নির্মিত হয়েছে। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক সজলকান্তি মণ্ডলের মতে, “ওই দু’টি কক্ষে বিপ্লবীদের গোপন সভা বসত বলে অনুমান করা যায়।” শুধু বিপ্লবীরাই নয়, রাজপরিবারের প্রতিরোধে রসপালে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় লোহার, বাগদি, ভূমিজ, শবর প্রজারাও। সম্ভবত রসপালের রাজা মুকুটনারায়ণের আমলে রাজবাড়ির কাছে জঙ্গলের ধারে নিষ্কর হাটের প্রবর্তন হয়, যেখানে শুধু বনজ সম্পদ বিক্রি হত। আজও প্রতি সোমবার সেই হাটের ধারা অক্ষুণ্ণ আছে। আজও রাজবাড়ির দুর্গাপুজো হয়, প্রচলন মেনে মোষ বলিও হয়। বলি দেন শবরেরা।

আঞ্চলিক ইতিহাসের গুরুত্ব মাথায় রেখে রসপালকে কেন্দ্র করে একটি নতুন ভ্রমণ-পথ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে। রাইপুরের বিডিও দীপঙ্কর দাস জানালেন, “রাজবাড়ি ও মন্দিরটির সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। মুকুটমণিপুরে যে সব পর্যটক আসেন, তাঁরা স্বচ্ছন্দে এই রাজবাড়িটি দেখে যেতে পারেন। পিকনিকও করা যেতে পারে। তার পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে।” না হয় চড়ুইভাতির ছোঁয়াতেই জাগল ঘুমিয়ে পড়া ইতিহাসের কলকাকলি।

খোল দ্বার

চার বছর বয়সে খেলাচ্ছলেই শ্রীখোল বাজানোর শুরু। প্রথম হাতেখড়ি বাবার কাছে। বাবা, শ্যামাপদ হালদার ছিলেন প্রখ্যাত খোল-শিল্পী। তার পরে ক্রমে খোল দিয়েই দুয়ার খুলে গেল হরেকৃষ্ণ হালদারের। বর্ধমানের লোহনা গ্রামে ১৯৭৫-এ জন্ম হরেকৃষ্ণর। মানচিত্রে বর্ধমান জেলায় পড়লেও কীর্তনে ভেসে যাওয়া নদিয়ার কাছেই সে গ্রাম। প্রায় দশ বছর হরেকৃষ্ণ খোল শিখেছেন নদিয়ার কৃষ্ণদাস বৈরাগ্য ও বৃন্দাবনদাস বৈরাগ্যের কাছে। তার পরে সোনার গৌরাঙ্গ মন্দিরের নিত্য মৃদঙ্গসেবক জগবন্ধু দাস বৈরাগ্যের কাছে তালিম। কীর্তনের দলে পেশাদার খোল-বাদক হিসেবে শিল্পী-যাত্রা শুরু তাঁর। বিভিন্ন আসরে বাজিয়েছেন সরস্বতী দাস, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতবরণ দাসের মতো পদাবলি কীর্তনের শিল্পীর সঙ্গেও। কিন্তু শ্রীখোলকে কীর্তনেই সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। শুধু মাত্র শ্রীখোল বাজিয়ে সহজ পরব-এর মতো উৎসব উদ্বোধন করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন তিনি সেখানে অতিথি-অধ্যাপক। এ বার কালিকাপ্রসাদ ও দোহার-এর অনুষ্ঠানে হরেকৃষ্ণর শ্রীখোল আবার মহানগরে, ২৯ নভেম্বর জ্ঞানমঞ্চে, ‘আনন্দসভা’র নিবেদনে।

প্রবাল-সন্ধান

সাহিত্যের গবেষক ‘মাস্টারমশাই’ স্বভাবে প্রচারবিমুখ। কিন্তু গাছের পরিচর্যা থেকে সাগরদ্বীপে সামজিক কাজ সবেতেই আছেন প্রবালকান্তি হাজরা। এ বার তাঁকে নিয়েই ক্রোড়পত্র করল পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল থেকে প্রকাশিত লোককৃতি পত্রিকা। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা, বাংলার লোক সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর গবেষণা গ্রন্থগুলিরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে হরপ্রসাদ সাহু সম্পাদিত পত্রিকাটির বিভিন্ন প্রবন্ধে। পত্রিকার শেষ দিকে প্রবালবাবুর লেখা ‘পূর্বাচলের পানে তাকাই’ খানিকটা যেন আত্মকথার মতো। বেশ কয়েক জন ব্যক্তিত্বের সম্পর্কে তাঁর বিরূপ অভিজ্ঞতাও তাতে বাদ যায়নি।

ছোটদের কলম

বড় স্কুলে ছাপানো পত্রিকা হয়। কিন্তু স্যাঁতসেঁতে, ভাঙাচোরা বা সদ্য তৈরি ইট বের করা প্রাথমিক স্কুলের কচিকাঁচারা কোথায় আঁকবে, লিখবে? ধুলোয় আঁক কাটা ছাড়া তাদের েআর গতি কী? বড় জোর হতে পারে দেওয়াল পত্রিকা। বীরভূমের প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সৃষ্টি কিন্তু এ বার ধরা পড়ল দুই মলাটে। ধনঞ্জয়বাটীর মিজানুল মনের আনন্দে লিখে ফেলল দুই বানরের গল্প। কাক-কোকিলের ডাকাডাকি ছড়ায় ধরল চকমণ্ডলার রুমা। বনডাঙার আকাশ আর আতুকুলার সাহিনা এঁকে ফেলল সামনের আর পিছনের প্রচ্ছদ। কলমকলি নামে অভিনব পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্ট।

রং কারবারি

ডাক্তারের চেনা কারবার রোগব্যাধি নিয়ে। তবু কেউ-কেউ স্বভাবদোষেই রঙের কারবারি। কারও রং ক্যানভাসে, কারও ডিজিটাল ক্যামেরায়। বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের উপরে ছোট প্রেক্ষাগৃহ তথা প্রদর্শশালায় দেখা মিলল এমনই দুই কারবারির। চিকিৎসক প্রদীপ চৌধুরী পোক্ত আঁক কেটেছেন ক্যানভাসে, অস্থি তথা শল্য চিকিৎসক পল্লব দাশ লেন্সে ধরেছেন ক্ষণমুহূর্ত। শুধু তাঁরাই নন, গত শুক্র থেকে রবিবার দেওয়াল জুড়ে রইল ইন্দিরা হালদার, চিন্ময় চক্রবর্তী, সঞ্জীব দাসের ছবিও। হাওড়ার বালিতে ‘এক্সপোজিশন’ নামে প্রদর্শনী এই নিয়ে তিন বছরে পড়ল। সঙ্গে পল্লব দাশের তোলা এবং প্রদীপ চৌধুরীর আঁকা ছবি।

দর্পণে সিনেমা

চলচ্চিত্রের পর্দা যাকে দেখায়, সে কি জীবনের প্রতিকৃতি না প্রতিবিম্ব? আবার, চলচ্চিত্র চর্চা ধরে রাখে যে লেখালেখি, তা কি সিনেমারই আখরে প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব? এ হেন সব চিন্তা উসকে দিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটির দ্বিভাষিক মুখপত্র প্রতিবিম্ব-এর সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ বিশেষ সংখ্যা। মননশীল চলচ্চিত্র পত্রিকা কখনও জাল বোনে নির্দিষ্ট বিষয়কে ঘিরে, কখনও বেছে নেয় সিনেমা ব্যক্তিত্ব। নানা বিষয়ে নিবন্ধ সাজিয়ে দেওয়ার চলও সমধিক রয়েছে। এ বারের মুখপত্রটি শেষ ধারারই অনুসারী। বীতশোক ভট্টাচার্য, ধ্রব গুপ্ত, প্রলয় শূর, ধীমান দাশগুপ্ত, এমনকী জাদুকর পি সি সরকারের বিভিন্ন সময়ে ছাপা হওয়া নিবন্ধ বেছে-বুছে যেমন সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, রয়েছে গাস্তঁ রোবের্জের নতুন লেখাও। ১৪ বছর আগে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে লিখেছিলেন পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদক সিদ্ধার্থ সাঁতরা। সেই লেখাটিও এই সংকলনে ঠাঁই পেয়েছে।

সাতকাহন

বর্ধমান যেখানে বীরভূমে মিশেছে, সেখানেই অজয়ের পাশে সাতকাহানিয়ায় গড়ে উঠেছে নাট্যগ্রাম ‘তেপান্তর’। চার একর জমিতে গড়ে ওঠা যে গ্রামে স্পেস থিয়েটার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছেন এবং আমরা নাট্যদলের সদস্যেরা। পাশেই গড়জঙ্গল আর ধর্মমঙ্গলে বর্ণিত কুলপতি ইছাই ঘোষের শ্যামারূপার মন্দির। কথিত, রাজা লাউসেনের সঙ্গে এখানেই যুদ্ধ হয়েছিল ইছাইয়ের। এখন সেখানে মাদলের শব্দ, বাউল-ঝুমুরের সাতকাহন। ২১-২৩ নভেম্বর হল লোক উৎসব।

ছবি-শিকারি

ছেলেবেলায় বিহারের প্রত্যন্ত যে শহরে থাকতেন, সেখানে পাখি শিকার ছিল শখের খেলা। সে দিন যে সব পাখি বাড়ির আশেপাশে শিকার করেছেন, এখন গভীর জঙ্গলে গিয়েও তাদের দেখা মেলা ভার, এই আফশোস কুরে কুরে খায় তাঁকে। তাই বনের বাসিন্দাদের নিজের ক্যামেরায় ধরে রাখা তাঁর ধর্মাচরণ। বিশ্বনাথ রায়চৌধুরীকে পেতে হলে যেতে হবে সুন্দরবনে, কিংবা ডুয়ার্সে। নইলে অন্য রাজ্যের অভয়ারণ্যে, পাহাড়ে বা মরুভূমিতে। সেই সঙ্গে অন্য যারা ফটোশিকারী, বাইনোকুলার-বাগীশ, তাঁদেরও জায়গা করে দিতে ভালবাসেন। একুশ বছর ধরে তাই নিয়মিত প্রকাশ করছেন ‘এনভায়রন,’ এ রাজ্য থেকে প্রকাশিত প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী বিষয়ে সেরা জার্নালগুলির একটি। প্রকৃতির অসামান্য সম্পদকে বাঁচানো যে কেবল শখের ব্যাপার নয়, তার জন্য দরকার দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম, অরণ্য-ঘনিষ্ঠ মানুষদের সাহচর্য, সে বোধ থেকে শুরু করেছেন ‘নেচার, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি’ বা ‘নিউজ’ সংস্থাটি। সুন্দরবনের মানুষকে উৎসাহ দিয়ে সুন্দরী গাছ রোপণের ব্যবস্থা করা যার অন্যতম কাজ। সেই সঙ্গে তৈরি করছেন প্রাণীদের পায়ের ছাপের ‘ম্যানুয়াল।’ আদ্যন্ত ভদ্রলোক, সতত হাসিমুখ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী তাঁর বাছাই ছবিগুলি নিয়ে এ বার প্রকাশ করলেন ‘ডেজ ইন দ্য ওয়াইল্ড’ বইটি। রয়েছে ২৭৫টি ঝকঝকে ছবি। রবিবার কলকাতায় বইটির উদ্বোধন হল মনোজ্ঞ একটি অনুষ্ঠানে। গোটা ভারতের বহু পরিচিত, অল্প-পরিচিত প্রাণীর ছবি রয়েছে। তবে বেশির ভাগ পাখি, আর বেশ কিছু প্রাণী-সরীসৃপ এ রাজ্যের। মলাটে অবশ্যই সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন