মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন গত বছর মে মাসে। কিন্তু আট মাস পরেও রাজ্যে নতুন ৭টি কর্পোরেশন গঠনের প্রক্রিয়া বিশ বাঁও জলে!
সারদা-কাণ্ডে মন্ত্রী-সাংসদদের গ্রেফতারি, তৃণমূলে ভাঙন ও বিজেপির উত্থান সব মিলিয়ে রাজ্যের শাসক দল এখন ঘোর বিড়ম্বনায়। এর মধ্যে বেশ কিছু পুরসভাকে জুড়ে ৭টি কর্পোরেশন তৈরির ঝুঁকি নেওয়াটা রাজনৈতিক ভাবেও বেশ চাপের। কারণ, তাতে কাউন্সিলরের সংখ্যা কমে যাবে অনেক। তৃণমূলের পদ-প্রত্যাশী নেতা-কর্মীদের প্রবল চাপের মুখে পড়তে হবে শীর্ষ নেতৃত্বকে। সেই চাপ সামলাবে কে!
এত দিন গোটা রাজ্যে সংগঠন সামলেছেন মুকুল রায়। সারদা মামলায় সিবিআইয়ের তলব পাওয়ার পর থেকে তিনি সুপ্রিম কোর্টের মামলা নিয়ে জেরবার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের রাশ নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কথা বললেও তিনিও বুঝতে পারছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই ৭টি কর্পোরেশন তৈরির কাজে এগোলে জেলায় জেলায় যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে আসন্ন পুরভোটে বিপর্যয় এড়াতে ছোট পুরসভাগুলিকে জুড়েবড় ছাদের তলায় আনার প্রক্রিয়া থেকে রাজ্য সরকার আপাতত সরে আসছে। নবান্ন সূত্রেই এই ইঙ্গিত মিলেছে। একই ইঙ্গিত দিচ্ছেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং জেলা স্তরের নেতারাও। জেলায় জেলায় তৃণমূলের নেতারা কার্যত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন এতে।
কেন? ব্যাখ্যা দিলেন দলের এক শীর্ষ স্তরের নেতা। তাঁর বক্তব্য হুগলির ১১টি পুরসভাকে একছাদের তলায় আনলে ১১ জনের বদলে মাত্র এক জন চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পেতেন। ওই পুরসভাগুলিতে এখন অন্তত ২৮০ জন কাউন্সিলর রয়েছেন। কর্পোরেশন হলে পুর-নির্বাচনের মুখে তাঁদের অনেকে বিদ্রোহী হতেই পারতেন। অন্য দলে নাম লেখালেও আশ্চর্যের কিছু থাকত না। সুযোগ নিত বিরোধী দলগুলি। তাতে পুর নির্বাচনের ভোটের ফলে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল। তা ছাড়া, নতুন ব্যবস্থা ভোটাররা কেমন ভাবে নেবেন, ছিল সেই প্রশ্নও।
তবে নয়া কর্পোরেশন গঠন পিছিয়ে যাওয়ায় আখেরে ক্ষতি কিন্তু রাজ্যেরই। ছোট ছোট পুরসভা থাকলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা তত মেলে না। টাকার অভাবে অনেক উন্নয়নের কাজ করা যায় না। তার বদলে কর্পোরেশন হলে কেন্দ্রের কাছ থেকে অনেক বেশি সহায়তা মিলতে পারে। গতি আসতে পারে প্রশাসনিক কাজে, এবং সার্বিক ভাবে উন্নয়নে। মূলত এই আশাতেই নতুন ৭টি কর্পোরেশন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪টি কর্পোরেশন বারাসত, দমদম, ব্যারাকপুর এবং মহেশতলা একেবারে নতুন। বাকি তিনটি, আসানসোল, হাওড়া ও হুগলিতে গঙ্গাপারের ১১টি পুরসভাকে নিয়ে সদর শ্রীরামপুর। কেন্দ্রের কাছ থেকে এই সব এলাকার উন্নয়নে বাড়তি সহায়তা পাওয়ার আশা আপাতত শিকেয় উঠল।
মুশকিলে পড়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনও। রাজ্য সরকার নতুন ৭টি কর্পোরেশন গড়ার সিদ্ধান্তের কথা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। সেই মতো নির্বাচনী নির্ঘণ্ট তৈরিরও প্রস্তুতি চলছে। গত জুন মাসে যে ১৭টি পুরসভার ভোট ছিল, তার মধ্যে ৭টিকে কর্পোরেশনে উন্নীত করার কথা ঘোষণা করে সরকার। বাকি ১০টিতে এ বছরের ৩০ জানুয়ারির মধ্যে ভোট করানোর নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। যদিও তার প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। ওই পুরসভাগুলিকে বাদ দিয়ে আরও ৮১টি পুরসভায় আগামী ২৬ এপ্রিল ভোট করার জন্য রাজ্য সরকারকে ইতিমধ্যেই প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। কিন্তু নতুন কর্পোরেশনই যদি না গড়া হয়, তবে যে পুরসভাগুলিকে বড় ছাতায় আনার কথা রাজ্য সরকার জানিয়েছে, সেগুলিতেও ভোট করানোর প্রশ্ন থেকে যাবে।
এখন তাই ঠিক কতগুলি পুরসভায় ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে তা নিয়েই ধন্দে পড়েছে কমিশন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের বক্তব্য, “রাজ্য সরকার আমাদের কর্পোরেশন গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। তার ভিত্তিতেই আমরা নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছি। কর্পোরেশন গঠনের প্রক্রিয়া যে সম্পন্ন হয়নি, এমন কোনও বিষয় আমাদের জানানো হয়নি।”
এখন তবে রাজ্য সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে কী সিদ্ধান্ত নেবে এ ব্যাপারে? কী জানাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে?
এ সব নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বা পুরসচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা। তবে নবান্ন সূত্রের খবর, নয়া কর্পোরেশন গঠন স্থগিত রেখেই পুরভোট করাতে চায় রাজ্য সরকার। এর পিছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলেও দাবি রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের। এক কর্তার বক্তব্য, “কর্পোরেশন গঠন হলে ওয়ার্ড কমবে। ওয়ার্ড-পিছু প্রার্থিপদের দাবিদার বেড়ে যাবে অনেক। এতে প্রবল কোন্দল দেখা দিতে পারে দলে। সে কারণেই নতুন কর্পোরেশন গঠনের ব্যাপারে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়া হয়েছে।” এর ইঙ্গিত অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর গত ১০ জানুয়ারির বৈঠকেই। আসন্ন পুর-নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন জেলার পুরপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করলেও পুরসভাগুলির সংযুক্তি নিয়ে সে দিন একটি শব্দও খরচ করেননি মুখ্যমন্ত্রী।
নয়া কর্পোরেশন গঠনের কাজ তবে এখন কোন পর্যায়ে?
এই প্রশ্নে পুর দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এর জন্য রাজ্য পুর আইনের সংশোধন করতে হবে। তবে তার আগে এগুলির ভৌগোলিক চেহারা ঠিক করা দরকার। সব ক’টির ক্ষেত্রেই ওই সব প্রশাসনিক কাজ মাঝপথে থেমে রয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “কিছু ক্ষেত্রে ফাইল পড়ে রয়েছে আইন দফতরে, আর কিছু রয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে। পরিস্থিতি যা, তাতে গোটা প্রক্রিয়া শেষ করতে আরও প্রায় আট মাস লাগবে।”
ওই কর্তার তাই দাবি, “এখন কর্পোরেশন গঠন না করে ভোট-বকেয়া সব পুরসভাতেই নির্বাচন করা ছাড়া সরকারের কাছে অন্য কোনও রাস্তা নেই।”
সহপ্রতিবেদন: প্রকাশ পাল