দলীয় কর্মীদের কাছে তাপস এখন ‘চন্দননগরের মাল’

এটাও এক ধরনের পরিবর্তন বইকি। আলালের দুলাল থেকে রাতারাতি তাঁর পরিচয় বদলে হয়েছে, ‘চন্দননগরের মাল’। চৌমুহা কাণ্ডের পরে, শাসক দলের কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল যে দলীয় নেতা-কর্মী, সকলের কাছেই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, রাখঢাক না রেখেই তা কবুল করছেন নদিয়া জেলা নেতারা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৪১
Share:

এটাও এক ধরনের পরিবর্তন বইকি।

Advertisement

আলালের দুলাল থেকে রাতারাতি তাঁর পরিচয় বদলে হয়েছে, ‘চন্দননগরের মাল’।

চৌমুহা কাণ্ডের পরে, শাসক দলের কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল যে দলীয় নেতা-কর্মী, সকলের কাছেই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, রাখঢাক না রেখেই তা কবুল করছেন নদিয়া জেলা নেতারা।

Advertisement

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে পালপাড়া মোড় ঘুরে কৃষ্ণনগরের রাস্তায় তাঁর শ্যাওলা রঙের ঢাউস স্করপিও গাড়িটা বাঁক নিলেই যে চেনা ভিড়টা এত দিন হুমড়ি খেয়ে পড়ত, মাস দুয়েক ধরে তা উধাও হয়ে গিয়েছে। বরং দিন কয়েক আগে তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরতে পারেন শুনে, দলের কয়েকজন নেতা ‘কাজ আছে’ অজুহাতে তড়িঘড়ি পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। কেন?

উত্তরটা সহজ, চৌমুহার বিড়ম্বনা ঝেড়ে ফেলতে ঝলমলে পাঞ্জাবি, চাপা জিনস, রঙিন চুলের রুপোলি পর্দার নায়ককে একরকম ব্রাত্য করেছেন নদিয়ার নেতা-কর্মীরা। একদা তাপস-ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতার কথায়, “মাস কয়েক আগেও দলের মহিলা কর্মীরা আমার কাছে আবদার করতেন, তাপসের একটা অটোগ্রাফের জন্য। এখন তাঁরা ওঁর নাম শুনলেই চটে যাচ্ছেন।”

জুনের মাঝামাঝি এক দলীয় কর্মী খুনের পরে নাকাশিপাড়ার চৌমুহা, হরনগর-সহ পাঁচ-পাঁচটা গ্রামে গিয়ে শাসক দলের সাংসদের হুমকি ছিল, ‘দানা পুরে দেওয়া’র। সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে ‘ছেলে ঢুকিয়ে রেপ’ করানোর শাসানিও দিয়েছিলেন তিনি। শুধু মহিলা মহলেই নয়, দলীয় নেতাদের কাছেও তাপস এখন তাই বিড়ম্বনার অপর নাম হয়ে উঠেছেন। তাপস অনুগামী কয়েক জন দলীয় নেতা, এ ব্যাপারে কর্মীদের ক্ষোভ প্রশমনে বার কয়েক বৈঠকও করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। ফল মেলেনি। দলের খবর, নিচুতলার কর্মীরা প্রায় এক জোট হয়েই জানিয়ে দিয়েছেন, ওঁর (তাপস পাল) হয়ে কথা বলা মানে দলের সমর্থন নষ্ট করা। সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়ের পরে সেই অস্বস্তি আরও বেড়েছে। চৌমুহা ঘটনায় ভিডিও ফুটেজে তাঁর মুখ ধরা পড়ায় দলের এক কর্মীর আর্তি, “দয়া করে আমার মুখটা বাদ দিয়ে দিন না দাদা। বাড়িতে মা-বোনের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।” অন্য এক কর্মীর আবেদন, “তাপস পালের ওই মন্তব্যের পরে আমার স্ত্রী-মেয়ে আমার সঙ্গেই কথা বন্ধ করে দিয়েছেন।”

দলীয় নেতা-কর্মীদের মতো অস্বস্তিতে পড়েছে পুলিশও। এত দিন এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকা জেলা পুলিশ কর্মীদের অনেককে আক্ষেপ করতে শোনা গিয়েছে, “হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি মনে হচ্ছে। উপরতলার নির্দেশ মেনে ওঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখও দেখাতে পারছি না।” শুক্রবার সন্ধ্যাতেও নাকাশিপাড়া থানায় সাংসদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেনি পুলিশ। ফলে তদন্ত শুরু করতে পারেনি সিআইডি।

নির্বাচনের আগে প্রচার পর্বে তাপসের নিত্যসঙ্গী এক তৃণমূল কর্মী চৌমুহা, গোপীনাথপুর, তেঘড়ি, সবর্ত্রই ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, “তখন কি জানতাম যে, এমন এক নোংরা মন্তব্যের সাক্ষী থাকতে হবে আমাকে? ভিডিও ফুটেজে নিজের মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি নিজেও অপরাধী।” দলের অন্য এক নেতা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, “কেন তাপস এমন বলল জানি না। এখন তো ওঁর হয়ে ভোট চেয়েছি ভাবতেই লজ্জা করছে।” গত জুন মাসে সাংসদের ওই মন্তব্যের পরে দলের নাকাশিপাড়ার বিধায়ক কল্লোল খাঁ স্পষ্টই বলেছিলেন, “কোনও জনপ্রতিনিধির এই ধরনের মন্তব্য করা উচিত নয়।” এ দিনও তিনি যে সে জায়গা থেকে সরছেন না তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

কৃষ্ণনগরের বেলেডাঙা মোড়ের কাছে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তাপস, সেই বাড়িও ছেড়ে দিতে হয়েছে তাঁকে। বাড়ির মালিক সুভাষ বসু অবশ্য বলেন, “আমি আগেই তাপসকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। কারণ আমার ওই ঘরটা এখন খুব প্রয়োজন।’’ দলের অন্দরের খবর অবশ্য অন্য। চৌমুহা কাণ্ডের পরে সুভাষবাবু তাপসকে ঘর ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ওই ঘটনার পর কৃষ্ণনগর শহরে তাপসের বাড়ি খোঁজার অভিজ্ঞতাও যে খুব একটা সুখকর ছিল না, তা কবুল করেছেন দলীয় কর্মীরা। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নতুন একটি বাড়িতে কিছু মালপত্র রেখে গিয়েছেন সাংসদ। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের পরে সাংসদকে কি সে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে? বাড়ির মালিকের শ্যালক প্রসেনজিৎ বিশ্বাস কোনও উত্তর দিতে চাননি।

দলের এক নেতা বলেন, “তাপসদাকে নিয়ে নিজের বাড়ির লোকের কাছেই গালমন্দ শুনছি। আগে নিজের মতো করে মা-বউকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। এখন হাইকোর্টের নির্দেশের পর আর সে সুযোগ কোথায়!”

কৃষ্ণনগরও কি সে কথাই বলছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন