নিজের কাঁধে দায় নিয়ে ঢাকাকে নথি দেবে কেন্দ্র

বর্ধমান বিস্ফোরণ নিয়ে জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, গোটা ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সার্বিক গাফিলতির দিকে আঙুল তোলা হয়েছে রিপোর্টে। এই রিপোর্ট থেকে তথ্য নিয়েই আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশকে একটি ডশিয়ার দিতে চলেছে দিল্লি। তবে অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে যা-ই থাক, ডশিয়ারে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী যাবতীয় ঘটনার দায়ভার নেবে কেন্দ্রই।

Advertisement

অগ্নি রায় ও অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৮
Share:

বর্ধমান বিস্ফোরণ নিয়ে জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, গোটা ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সার্বিক গাফিলতির দিকে আঙুল তোলা হয়েছে রিপোর্টে। এই রিপোর্ট থেকে তথ্য নিয়েই আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশকে একটি ডশিয়ার দিতে চলেছে দিল্লি। তবে অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে যা-ই থাক, ডশিয়ারে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী যাবতীয় ঘটনার দায়ভার নেবে কেন্দ্রই।

Advertisement

এনআইএ-র তদন্তে প্রকাশ, ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চার বছরে কয়েকশো কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গ থেকে চোরাপথে পৌঁছেছে সৌদি আরব-সহ মধ্য এশিয়ার একাধিক দেশে। যা পরে ব্যবহার করা হয়েছে সন্ত্রাসের কাজে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ইতিমধ্যেই কী ভাবে হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে, তার তদন্ত শুরু করেছে। আজ বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে এনআইএ রিপোর্টের বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন গোয়েন্দারা।

ডশিয়ারে বাংলাদেশকে কী জানাতে চায় দিল্লি? গোয়েন্দাদের রিপোর্ট বলছে, জঙ্গিগোষ্ঠী জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) তাদের জাল বিছিয়েছে অসমের বরপেটা-ধুবুরি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদহ-নদিয়ার মতো একাধিক জেলায়। একটি বৃহত্তর ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে আইএসআই তথা আল কায়দার একটি বৃহৎ পরিকল্পনা দীর্ঘ দিন ধরেই সক্রিয় রয়েছে। সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই এগোচ্ছিল জেএমবি। নিরুপদ্রবে কাজের জন্য ওই তিন জেলায় একাধিক স্থানে বেশি দামে জমি কিনে মাদ্রাসা বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। জেএমবি-র বর্ধমান মডিউলের মাথা সাজিদ প্রায় সাড়ে আট লক্ষ টাকা দিয়ে লালগোলায় মাদ্রাসার জন্য জমি কেনে। আর হাতকাটা নাসিরুল্লার উপরে দায়িত্ব ছিল বেলডাঙায় জমি কেনার।

Advertisement

বাংলাদেশ থেকে আসা জঙ্গিদের প্রতি নির্দেশ ছিল, এ দেশে ঢুকেই নিজেদের ভারতীয় পরিচয় তৈরি করে ফেলতে হবে। এ জন্য গরিব পরিবারের মেয়েদের বিয়ের রাস্তা বেছে নিয়েছিল জঙ্গিরা। পরবর্তী পদক্ষেপে স্ত্রীদের জেহাদি পাঠ দেওয়া হত শিমুলিয়া ও লালগোলার মাদ্রাসায়। শিমুলিয়ার মাদ্রাসায় মহিলাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল সাজিদ ও তার স্ত্রী। তাদের সাহায্য করত সুমের ও সাদিক নামে দুই ব্যক্তি। গোয়েন্দাদের অনুমান, খাগড়াগড় কাণ্ডে মৃত শাকিল ২০০৭ সালে ভারতে আসে। প্রথম দিকে তার মূল কাজ ছিল কৌসর শেখ ও কাদিরকে অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করা। পরে বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ পায় সে। গোয়েন্দাদের মতে, সীমান্তবর্তী বিভিন্ন মাদ্রাসা ও মডিউলের মধ্যে সূত্রধরের কাজ করত কৌসর। শাকিলের সঙ্গে ভারতে এসে জন্নত নামে এক মহিলাকে বিয়ে করে ভারতীয় নাগরিকত্ব জোগাড় করে সে।

গোয়েন্দাদের মতে, তিন বছরে ৪ দফায় ত্রিশটি-চল্লিশটি করে আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) অর্থাৎ প্রায় ১৫০টি বিস্ফোরক পড়শি দেশে পাঠানো হয়েছে। যেগুলি বানানোর মাথা ছিল কৌসর। শাকিল ও সুভানকে বিস্ফোরক তৈরির পদ্ধতি শেখায় সে। রোজ ৮-১০টি আইইডি বানাত শাকিলেরা। সেগুলি বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিল কৌসর, কাদের, আব্দুল হাকিম ও শাকিল। বিস্ফোরকের রাসায়নিক বস্তুর জোগানদার ছিল আমজাদ আলি। বর্ধমান বিস্ফোরণের পরে দিল্লিতেও আমদাজ কিছু দিন লুকিয়ে ছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। কী ভাবে জেএমবি নেটওয়ার্ক কাজ করত এবং বাংলাদেশে কোথায় কোথায় তাদের আস্তানা আছে, তা-ও থাকবে রিপোর্টে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্র জানাচ্ছে, গোয়েন্দাদের রিপোর্টের মূল তির কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দিকেই। সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলিতে দীর্ঘ দিন ধরেই সন্ত্রাসের চাষ শুরু হয়েছে। কিন্তু তা ঠেকাতে রাজ্য কোনও পদক্ষেপই করেনি বলে অভিযোগ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, বাম জমানাতেও জঙ্গি অনুপ্রবেশ ও হাওয়ালায় অর্থ লেনদেন হয়েছে সমান তালে। প্রায় ২৫টি গোপন সন্ত্রাস-মডিউল মালদহ-মুর্শিদাবাদ, বর্ধমানের মাদ্রাসাগুলির আড়ালে দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল। যাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের আওয়ামি লিগ নেতৃত্বের উপর আঘাত হানা।

রিপোর্ট বলছে, এ বছরের গোড়ায় বাংলাদেশে ভোটের আগে শেখ হাসিনা সরকার জামাতের বিরুদ্ধে ধরপাকড় শুরু করায় অনুপ্রবেশের হার বেড়ে যায়। তবে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার কড়া নীতি নেওয়ায় ও তাঁর সঙ্গে হাসিনার সুসম্পর্কের কারণে সে রাজ্যে ঘাঁটি গাড়ার প্রশ্নে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি জামাত জঙ্গিরা। তাদের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ ও অসম। অসমের বরপেটায় ধৃত ছয় সন্দেহভাজনের সঙ্গে বর্ধমান কাণ্ডের যোগ মিলেছে, জানান গোয়েন্দারা।

তবে অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের সমালোচনা করা হলেও অন্য রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা রিপোর্ট দেওয়ার সময় কোনও অঙ্গরাজ্যকে পৃথক ভাবে দায়ী করার রীতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত গোটা ঘটনার দায় বর্তাবে দিল্লির উপরেই। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, গোটা অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে ঘটনাটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর সাউথ ব্লকের কাছে। সামনেই সার্ক সম্মেলন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত বরাবর প্রতিবেশী দেশে সন্ত্রাস পাচার করা নিয়ে সরব হয়েছে। পাকিস্তান ও খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশকে দুষে এসেছে। আজ সেই অভিযোগ যদি ভারতের দিকে ফিরে আসে, তবে জবাবদিহি করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকেই। তবে বাংলাদেশ সেনার একটি কট্টরবাদী অংশের সঙ্গেও জেএমবি-র যোগসাজশ ছিল বলে তদন্তে পাওয়া গিয়েছে। দু’দেশের সীমান্ত এলাকায় স্লিপার সেলগুলিও উভয় পক্ষের সন্ত্রাস পরিকাঠামোয় মদত দিয়ে এসেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন