আজাদ-কাহিনি

নিজের হাতে তৈরি আজাদের ভয়ে ঘরবন্দি ছিল ডাবলুও

দু’হাতে বন্দুক চালানোয় যেমন ছিলেন সিদ্ধহস্ত, তেমনই ওস্তাদ ছিলেন বোমা বাঁধতে। এ হেন আজাদ মুন্সিকে খুন করে পুঁতে দেওয়া হল মঙ্গলকোটে অজয় নদের চরে। এই এলাকাই এক সময় ছিল আজাদের গোপন ডেরা, যেখানে পুলিশ ঢুকতেও ভয় পেত। কে এই আজাদ? কী ভাবে তাঁর উত্থান, পতনই বা কী ভাবে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার।কবাডি খেলায় যেমন পারদর্শী, তেমনই ছিলেন বন্দুক চালানোতেও ওস্তাদ। কবাডি প্রতিযোগিতায় একের পর এক পুরস্কার জিতেছেন, সে ভাবেই একের পর এক গ্রামের দখল নিয়েছেন। তাঁকে সামনে রেখেই বর্ধমান-বীরভূম সীমানা এলাকায় সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ বাহিনী’ গড়ে তুলেছিল তৃণমূল।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

মঙ্গলকোট শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৮
Share:

কবাডি খেলায় যেমন পারদর্শী, তেমনই ছিলেন বন্দুক চালানোতেও ওস্তাদ।

Advertisement

কবাডি প্রতিযোগিতায় একের পর এক পুরস্কার জিতেছেন, সে ভাবেই একের পর এক গ্রামের দখল নিয়েছেন।

তাঁকে সামনে রেখেই বর্ধমান-বীরভূম সীমানা এলাকায় সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ বাহিনী’ গড়ে তুলেছিল তৃণমূল। তাঁর ‘সাহসিকতা’র জন্য বর্ধমানের মঙ্গলকোট এলাকায় কেউ তাঁকে ‘ডন’, কেউ বা ‘বাঘ’ বলে ডাকতেন। তাঁর অনুগামীরা ‘বড় কত্তা’ নামেও ডাকতেন তাঁকে।

Advertisement

তিনি আজাদ মুন্সি। মঙ্গলকোটের আড়াল গ্রামের বাসিন্দা, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হাসিবুর রহমান মুন্সি ও রাবিয়া বিবির বড় ছেলে। যৌথ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা আজাদ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনো করেছেন। আড়াল গ্রাম থেকেই স্কুল যাওয়ার পথে আজাদকে দেখেন বাম আমলের ‘ত্রাস’ মঙ্গলকোটের ডাবলু আনসারি। সময়টা আজ থেকে ১৭ বছর আগে, ১৯৯৭ সালে। তখন ডাবলু কংগ্রেসের একজন কর্মী ছিলেন।

১৯৯৮ সালে ডাবলুকে সামনে রেখে মঙ্গলকোট পঞ্চায়েত দখল করে কংগ্রেস। ওই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ডাবলুর হয়ে ভোটের ময়দানে নেমেছিলেন আজাদ। ডাবলুকে আজাদ ‘চাচা’ বলে ডাকতেন। ডাবলু দলবদল করে সিপিএমে যোগ দিলেন। মঙ্গলকোট পঞ্চায়েতও সিপিএমের দখলে চলে এল। সেই সময় ডাবলু আনসারি মঙ্গলকোটের বুক থেকে বীরভূমের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। এলাকা দখলে রাখতে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াতেন আজাদ।

বছর খানেক যেতে না যেতেই ডাবলু-আজাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়। জানা যায়, ১৯৯৯ সালে আড়াল গ্রামে রাস্তা তৈরি নিয়ে তাঁদের বোঝাপড়ায় চিড় ধরে। এর পরে ২০০০ সালে ‘গরু-চোর’ অপবাদে সিপিএমের বাহিনী আড়াল গ্রামে আজাদের বাড়িতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। গ্রামছাড়া হয় আজাদ। আশ্রয় নেয় বীরভূমের তৃণমূল নেতা সোনা চৌধুরীর কাছে। তৃণমূলের অন্দর সূত্রে জানা যায়, নানুরের বাসাপাড়ায় তৃণমূলের দলীয় দফতরে বিভিন্ন এলাকার গ্রামছাড়ারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন থেকেই আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন আজাদ। মঙ্গলকোটের প্রাক্তন এক ওসি বলেন, “আজাদ বোমা তৈরিতে ওস্তাদ ছিল।”

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলকোট থানায় একসময় আজাদ পুলিশের গাড়ি চালাতেন। আবার পুলিশের ‘সোর্স’ হিসাবে এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। ২০০৬ সালে পুলিশের ‘সোর্স’ থাকার সময়েই মঙ্গলকোটের তৎকালীন ওসি আজাদকে বাইক ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার করেন। কয়েক মাস জেল খাটার পরে আজাদ ফের চলে যায় বাসাপাড়ায়। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখের সঙ্গে পরিচয় হয় আজাদের। বাসাপাড়ায় কিছুদিন থাকার পরে ২০০৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় মঙ্গলকোটে চলে আসেন আজাদ। তখনও মঙ্গলকোটের বুকে তৃণমূল জাঁকিয়ে বসেনি। ওই নির্বাচনে ডাবলুর সিপিএমের বিরুদ্ধে কংগ্রেস আজাদের বাবা ও কাকাকে প্রার্থী করে। এই নির্বাচনের পরে কুনুর নদীর সেতুতে বাস থেকে নামিয়ে আজাদের কাকার ছেলে সাইফুলকে খুন করার অভিযোগ ওঠে ডাবলুর দলবলের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার পরে আজাদের বাড়িতে যান বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল।

এরপরেই যেন ফের গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন আজাদ। পরপর বেশ কয়েকবার ডাবলুকে আক্রমণ করে আজাদ ও তার বাহিনী। পুলিশের এক কর্তার কথায়, “ডাবলুর কথায় মঙ্গলকোটে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত। অথচ আজাদের ভয়ে ডাবলু বাড়ি থেকে বেরনোই বন্ধ করে দিয়েছিল।” সেই সুযোগে তৃণমূলও মঙ্গলকোটের বুকে মাথা চাড়া দিতে শুরু করে। সেই সময়ের আজাদের সঙ্গীদের একাংশ জানান, বীরভূমের নেতা সোনা চৌধুরী খুনের পরে আজাদ পুরোপুরি কাজল শেখের আশ্রয়ে চলে আসেন।

ওই সময় সিপিএমের বিরুদ্ধে বর্ধমান-বীরভূমে ‘প্রতিরোধ বাহিনী’ গড়ে তুলেছিল তৃণমূল। নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখের কথায়, “বাহিনীর সেনানায়ক ছিল আজাদ। বোলপুর লোকসভা এলাকায় যেখানেই সিপিএম আক্রমণ করেছে, আজাদের নেতৃত্বে প্রতিরোধ বাহিনী তার মোকাবিলা করেছে। আর এর বিরুদ্ধে একের পর মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।” ওই প্রতিরোধ বাহিনীর সেই সময়কার এক সদস্য বলেন, “এক দিকে সিপিএমের হাত থেকে গ্রাম দখল করায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, আবার নানুরের যে কোনও প্রান্তে কবাডি প্রতিযোগিতায় ছেলেদের নিয়ে খেলতে চলে যেত আজাদ। ওর যা শক্তি ছিল ২-৩ জন খেলোয়াড়ও ওকে আটকাতে পারত না।” নানুরের বাসাপাড়া ও পাপুড়িতে তৃণমূলের দফতরের কবাডি প্রতিযোগিতায় জিতে টিভি পেয়েছিলেন আজাদ।

আজাদ-ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, ম্যাগজিন-রাইফেল চালানোর ব্যাপারে আজাদ সিদ্ধহস্ত ছিল। আর সে কারণে বেশ কয়েকবার হাতের নাগালে পেয়েও পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আজাদের দাপট যখন মধ্যগগনে তখন তৃণমূলের বর্ধমান-বীরভূমের একাধিক নেতা বারবার তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর হয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছেন।

২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতাবদলের পরে নানা জায়গায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠতে থাকে। মঙ্গলকোট, নানুরও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই সময় থেকেই কোণঠাসা হয়ে যেতে থাতে আজাদ।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন