হাড়োয়ার ব্রাহ্মণপাড়ায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলছেন সুধীরকুমার রাকেশ। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
তাঁর কাছে নালিশ জানাতে হাজির হয়েছিলেন সিপিএম নেতারা। কথার মাঝেই বেদী ভবনে নিজের ঘর থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এলেন তিনি। চোখেমুখে উত্তেজনা। আগের ক’দফায় তাঁকে যতটা নিশ্চিন্ত লেগেছিল, সোমবার যেন তা উধাও!
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রাজ্যের বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ বললেন, “এনাফ ইজ এনাফ। অব তো নিকলনা হি পড়েগা।”
ঘড়িতে তখন ১২টার কাঁটা পেরিয়েছে।
এর আগে বেলা ১১টা নাগাদই রাকেশের সঙ্গে দেখা করতে বেদী ভবনে পৌঁছেছিলেন সিপিএমের রবীন দেব, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। রবীনবাবুরা আসতেই নিজের ঘরে ঢুকে যান। বাম নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্যেই কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে ফোন করলেন তিনি। কড়া সুরে বললেন, “এ সব কী হচ্ছে? আরও সক্রিয় হন। দুষ্কৃতীদের রেয়াত করবেন না।” দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে সিপি-কে পদক্ষেপ করতে বললেন। রবীনবাবুরা অনুরোধ করলেন, নিউজ চ্যানেলে পরপর গণ্ডগোলের খবরের দিকে রাকেশ যেন নজর রাখেন।
বস্তুত সকাল থেকেই রাজ্যের ১৭টি লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক অভিযোগের ফোন, এসএমএস আসছিল রাকেশের মোবাইলে। তার পর উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় হামলার খবর পাওয়ার পর থেকেই বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন রাকেশ। যদিও কমিশন সূত্রের খবর, জেলাশাসক-এসপি দু’জনেই প্রথমে এসএমএসে রাকেশকে জানিয়েছিলেন, ‘বুথে কিছু হয়নি। বড় ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। গ্রামে ঝামেলা হয়েছিল। পুলিশ গিয়েছে। ভোটও চলছে।’
বেলা ১টা নাগাদ উপনির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসির সঙ্গে রাকেশের সরাসরি কথা হয়। তার আগে অন্য সূত্রেও পশ্চিমবঙ্গের হালচাল জেনে নিয়েছিলেন জুৎসি। তার ভিত্তিতে বিশৃঙ্খলার নানা অভিযোগ নিয়ে রাকেশের কাছে কার্যত কৈফিয়ত চান দিল্লির কমিশন-কর্তা। ফলে খানিকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় জুৎসির সঙ্গে কথা শেষ করে উত্তর ২৪ পরগনার ডিএম-এসপি’কে ফোনে ধরেন বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক। এবং তাঁদের কাউকে কার্যত কিছু বলার সুযোগ না-দিয়েই রাকেশ বলেন, “কোনও রিপোর্ট চাই না। শুধু ব্যবস্থা চাই। আপনারা দ্রুত তাই করুন।” জানিয়ে দেন, তিনি নিজেই ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন।
বিকেল ৪টে। ২০টি গাড়ি নিয়ে রাকেশের কনভয় ছুটল হাড়োয়ার ব্রাহ্মণচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে। পথে শহরের কালীকৃষ্ণ ঠাকুর রোডে নামলেন। এখানেই কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র তথা বিজেপি নেত্রী মীনাদেবী পুরোহিতের উপর হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল। রাস্তায় বোমা বিস্ফোরণের চিহ্নও দেখা গেল। মোতায়েন পুলিশকর্মীদের রাকেশ বলেন, “নির্ভয়ে নিজেদের কর্তব্য পালন করুন।” এর পর কাশীপুরের বুথে গিয়েও পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখেন তিনি। সেখানে সব দলের এজেন্ট রয়েছে কি না, খোঁজ নিলেন।
সেখান থেকে সোজা হাড়োয়া। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই হনহনিয়ে রাকেশ স্কুলের দু’টি বুথে ঢোকেন। প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চাইলেন, কোন কোন দলের এজেন্ট রয়েছেন। শুধু তৃণমূলের এজেন্টই হাজির শুনে কথা বললেন কমিশনের সেক্টর অফিসার পার্থ মজুমদারের সঙ্গে। বিশেষ পর্যবেক্ষকের সঙ্গে ছিলেন জেলার এএসপি, এসডিপিও-সহ বিরাট পুলিশ বাহিনী। বুথ থেকে বেরিয়ে এর পর পাশের গ্রামগুলির দিকে হাঁটা শুরু করেন রাকেশ।
প্রথমে মণ্ডলপাড়া। কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, তাঁরা ভোট দিতে পারলেও নস্করপাড়ার অনেকেই বুথে পৌঁছতে পারেননি। সেখানে কারও কারও গায়ে গুলিও লেগেছে। পায়ে হেঁটেই রাকেশ নস্করপাড়া চলে গেলেন। যেতেই তাঁকে ঘিরে ধরলেন এলাকার মানুষ। কী ভাবে তাঁদের উপর হামলা হল, গুলি চলল সব কথা বললেন রাকেশকে। রাকেশ তাঁদের আশ্বস্ত করতে চেয়ে বললেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাহারায় ভোটারদের ফের বুথে পৌঁছে দেওয়া হবে। তাঁরা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন। কিন্তু লাভ হল না। সমস্বরে রাকেশের প্রস্তাব নাকচ করে দেন গ্রামবাসীরা। আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে তাঁরা দু’টি বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানান। অনেকে বলতে থাকেন, “এখন বলছেন ভোট দিতে চলুন। আপনি চলে যাওয়ার পরে আমাদের নিরাপত্তা দেবে কে?” রাকেশ পাল্টা প্রস্তাব দেন, সোমবার রাত পর্যন্ত গ্রামে পুলিশ পিকেট থাকবে। কিন্তু তাতেও বরফ গলেনি। রাকেশের হাড়োয়া অভিযান কার্যত সফল হয়নি।
তা হলে কি কমিশনের উপরে গ্রামবাসীদের আস্থা নেই? বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের জবাব, “এই ঘটনার জন্য অবশ্যই কয়েক জনের গাফিলতি দায়ী। ভোটের আগে কোন জায়গা কতটা স্পর্শকাতর, তা ঠিক হয়। সেই কাজটা এখানে ঠিক মতো করা হয়নি মনে হচ্ছে।”
গ্রামে বেআইনি অস্ত্র ঢুকেছে শুনে তা খুঁজে বের করার জন্য সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন রাকেশ। নস্করপাড়া ছাড়ার সময় তিনি বলে যান, “বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের সন্ত্রাসের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম সহজে যেখানে পৌঁছতে পারে না, সে সব জায়গাতেই ঝামেলা বেশি।” রাকেশ এর পর দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়েও গিয়েছিলে। সেখানকার দু’টি বুথ ঘুরে তিনি কলকাতায় ফেরেন।