ভোটে জেতার জন্যই নাকি গুলি-বোমা, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট। এতদিনের এই ধারণা শনিবার ধাক্কা খেল পঞ্চায়েতের উপনির্বাচনে। গোটা রাজ্যে ৪১৫টি আসনে ছিল নেহাতই নিয়মরক্ষার ভোট। তার ফলের উপর গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির দখল নির্ভর করছিল না কোথাও। তা সত্ত্বেও দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব থেকে রেহাই মিলল না রাজ্যবাসীর। অনাবশ্যক হিংসায় কালনা এবং বসিরহাটে গুলিবিদ্ধ হলেন দু’জন। মুর্শিদাবাদে দু’জন বোমায় প্রাণ হারালেন। অপহরণ, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, বাইক-বাহিনীর তাণ্ডব, সাংবাদিক নিগ্রহের চেনা ছকও বজায় রইল পুরো মাত্রায়।
এ দিন মুর্শিদাবাদের ভরতপুর ২ ব্লকে তালিবপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে পূর্বগ্রামের কংগ্রেস প্রার্থী জয়ন্তী ঘোষের স্বামী রণদীপ ঘোষকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। খবর পেয়ে এসে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী সালার থানার সামনে ধর্নায় বসেন। দেড় ঘণ্টা পরে রণদীপবাবুকে উদ্ধার করে পুলিশ। তার পরেও দু’পক্ষের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। কংগ্রেসের দাবি, পূর্বগ্রামের দুটি বুথে তৃণমূলের লোক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পুলিশের সামনেই ঘুরেছে, বিরোধী এজেন্টদের বের করে দিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে।
শুক্রবার রাতে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার পাথরঘাটায় বোমার আঘাতে মারা যান জুলফিকর মণ্ডল (২৫) ও ইন্তাজুল মণ্ডল (২৭)। ঘটনায় জখম কংগ্রেস প্রার্থী জেহেদা বিবির ছেলে সাজু মণ্ডল। কংগ্রেসের দাবি, তৃণমূলের ছোড়া বোমাতেই দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। তৃণমূলের দাবি, বোমা বাঁধতে গিয়ে মারা যায় দু’জন।
বসিরহাটে এ দিন গুলিচালনায় অভিযোগের তির সিপিএমের দিকে। বসিরহাট ২ পঞ্চায়েত সমিতির একটি আসনে ভোট চলাকালীনই ঘোড়ারাস গ্রামে কংগ্রেস ও সিপিএম নেতা-কর্মীদের উপর তৃণমূলের বাইক-বাহিনী গুলি চালায় বলে অভিযোগ। গুলি লাগে সহিদুল মণ্ডল নামে তৃণমূল কর্মীর গায়ে। স্থানীয় তৃণমূল নেতারা সিপিএমকে দোষারোপ করলেও, সিপিএম নেতা আবুল কালাম দাবি করেন যে তাঁকে নিশানা করে ছোঁড়া গুলিই লেগেছে সহিদুলের গায়ে। এই গণ্ডগোলের মধ্যেই দুষ্কৃতীরা হানা দেয় স্থানীয় ভোটকেন্দ্রে। বসিরহাট থানার আইসি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলে ফের ভোট শুরু হয়।
বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বীরভূমের খয়রাশোল, উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, মালদহের ইংরেজবাজার, মানিকচক, কোচবিহারের মাথাভাঙার বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের কিছু আসনের উপনির্বাচনে। নদিয়ার সগুণা, কামালপুর, মোল্লাপাড়া ও বহিরগাছির মতো এলাকায় তৃণমূলের বহিরাগতদের দাপটে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা। হাওড়ার ডোমজুড়ে আবার তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়ল। কোলড়া ১ পঞ্চায়েত এলাকায় বোমার আঘাতে আহতও হন কয়েক জন। এই আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি, তৃণমূল প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই ছিল নির্দল প্রার্থীর। দলেরই একাংশ মেনে নিয়েছেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই এই ঘটনা।
হারজিতে যখন কিছুই আসে-যায় না, তখনও কেন এত হিংসা? রাজ্যের সদ্য-প্রাক্তন এক মুখ্যসচিব বলছেন, ‘‘শাসক দল এই সন্ত্রাস না করলেও জিতত, হয়তো ব্যবধান কম হত। তা-ও এমন কাণ্ড করল। এই ঔদ্ধত্যটাই বর্তমান শাসক দলের ‘ক্যারেকটার’।’’
বছর কয়েক আগে অবসর নিয়েছেন, রাজ্যের এমন এক স্বরাষ্ট্রসচিব ধরিয়ে দিচ্ছেন সূত্রটা, ‘‘সংগঠনের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারাটাই বাম আমলে রাজনৈতিক দলের মুন্সিয়ানার পরিচয় ছিল। এখন সেই নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই অপ্রয়োজনেও মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ছাপ্পা ভোট দিয়ে শাসক দল সমর্থন হারাচ্ছে।’’