শীতের পরেই আসে বসন্ত। আর বসন্ত আসলেই আমার মনটা চলে যায় সেই তিস্তা পারের দেশে।
সেই দেশ, যেখানকার গাছের ছায়াগুলো আমায় চেনে। সেই ছায়াঢাকা পথে পড়ে আছে আমার ডাকনামের দিনগুলো। সেই ছায়া এখনও আমায় বুলিয়ে দেয় স্নেহের পরশ।
তিস্তা পারের জলপাইগুড়িতে কেটেছে আমার ছোটবেলা। নদীর পারে সবুজে ঢাকা শহরটা ছিল ছবির মতো। শহরের পান্ডাপাড়াতেই থাকতাম আমি। আমাদের বাড়ি ছিল কালীবাড়ির কাছেই। পাশেই ছিল দুটো মাঠ। গোটা এলাকাই ছিল সবুজে সবুজ। এখন বাড়ি-ঘর অনেক বেড়ে গিয়েছে। তবে পড়শি গাছগুলো এখনও আছে। এক আছে সেই মন ভাল করা পরিবেশও। এই ফেব্রুয়ারিতেই গিয়েছিলাম দিদির বিয়েতে। দেখে এলাম তাদের।
বর্ষাকালটাও ছিল ছবির মতো। এখনও কলকাতায় বৃষ্টি হলে যেন আমি ওখানে জোরে জোরে সেই বৃষ্টির শব্দ পাই। আরেকটা শব্দ ভোলার নয়। তা হল ব্যাঙের ডাক। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই চলত একটানা সেই ডাক। উত্তরবঙ্গ ছাড়ার পরে সেই ডাক আর কোথাও শুনতে পাইনি।
জলপাইগুড়ির হোলি চাইল্ড স্কুলে আমার ছোটবেলা কেটেছে। তারপরে বিন্নাগুড়ির সেন্ট জেমস স্কুল। স্কুলে কিছু একটা ছুটি মানেই আমাদের কাছে ছিল ডুয়ার্স। মূর্তি নদীর পাশে কতবার যে ঘুরতে গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। শুধু মূর্তি কেন, ডুয়ার্সের কোনও নদী, জঙ্গলই আমার বাকি নেই! স্কুল শেষ করে কলেজে পড়তে কলকাতায় এসে যখন শুনতাম আমার কোনও বন্ধুবান্ধব ডুয়ার্সে যাচ্ছে, বলতাম, ‘‘ডুয়ার্সে! ওখানে আবার কী আছে?’’
এখন বুঝেছি ওখানে কী আছে। যতই বুঝি ততই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। ওখানে প্রকৃতি এমন উপুড় করে দিয়েছে যে যারা ওখানে কিছুদিন কাটিয়েছে ব্যাপারটা তারাই বুঝতে পারবে। ওই জঙ্গলের মধ্যে হাতির পাল, বাইসন, হরিণের চকিতে চলে যাওয়া— আর কোথাও পাব না।
আমার পুরো শৈশব-কৈশোরটাই জঙ্গলের কাছাকাছি কেটেছে। জলপাইগুড়িরও আগে একদম ছোট্টবেলায় আমি থেকেছি অরুণাচল প্রদেশে। সেখানকার জঙ্গল একরকম। আবার আমাদের ডুয়ার্স আরেকরকম। বিন্নাগুড়ি সেন্ট জেমসে পড়ার সময় আমি থাকতাম বীরপাড়ায়। সেখান থেকে স্কুলে যেতে লাগল এক ঘণ্টা। আমাদের চার-পাঁচটা স্কুলবাস পরপর যেত। পুরো রাস্তার দু’দিকেই জঙ্গল আর চা বাগান।
বর্ষাকালে অনেক সময় একটা মজা হত। নদীর তোড়ে ব্রিজ ভেঙে যেত। আর আমাদের স্কুলবাসগুলো ঘুরপথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘণ্টা দুই-তিন দেরিতে স্কুলে পৌঁছত। আর, আমাদের কী মজা। স্কুলে যাওয়ার খানিক পরেই ছুটি!
তবে ছুটি বলতে যেটা মনে পড়ে সেটা হল অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষের পরে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ পরীক্ষাগুলো শেষ হত। সেই বসন্তের সময়েই ফুল আসত আমাদের বাড়ির আলুবখরার গাছে। সাদা তুলোর মতো ফুল হয় আলুবখরায়। মনে হত যেন গাছের উপরে বরফ পড়ে আছে। আরেকটা গাছ ছিল যার নাম জানি না। লাল টুকটুকে ফুল হত সেই গাছে। পাপড়িগুলো ছিল নখের মতো। আমরা জল দিয়ে সেই ফুলের পাপড়ি নখে লাগিয়ে ঘুরতাম। ফুলগুলোকে ডাকতাম নখফুল বলে। দশ বন্ধুর জন্য নিয়ে যেতাম দশটা নখফুল।
উৎসব-অনুষ্ঠানের দিনগুলোও কাটত হইহই করে। আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রজয়ন্তী হত। সব ভাইবোনরা মিতে তাতে যোগ দিতাম। তবে আমি বেশ লাজুক ছিলাম। তাই বেশিরভাগ সময়েই দর্শক হয়েই থাকতাম। আরও বেশি মজা হত পাড়ায় কালীপুজোর সময়ে। তখন আমাদের গোটা পাড়া জুড়ে চলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। কারও একটা ফাঁকা বাড়ি জুড়ে চলত অনুষ্ঠানের মহড়া। এক ঘরে যদি নাটক হচ্ছে, তো পাশের ঘরে নাচ। একঘরে যদি গানের রিহার্সাল চলছে তো পাশের ঘরে চলছে আড্ডা। যেন কার্নিভ্যাল চলত গোটা পাড়া জুড়ে। খাবারও খাওয়া হত দলবেঁধে। যেদিন যাদের বাড়িতে যা ভাল মেনু হত, তাই আসতো সবার জন্য। কোনও দিন পাবদা মাছ তো কোনও দিন চিলি চিকেন!
খাওয়াদাওয়ার আরেকটা মজা ছিল চড়ুইভাতিতে। শহর কলকাতায় শীতকালে যেমন পার্টি হয়, আমাদের তেমন ছিল চড়ুইভাতি। ডুয়ার্সের জঙ্গলঘেরা নদীর ধারে দলবেঁধে চড়ুইভাতি করতে যেতাম আমরা। একসঙ্গে বসে খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা!
শীতকাল আসছে। আবার আমার মনে পড়ছে চড়ুইভাতির কথা। আমি মাঝে মাঝে একা একা জঙ্গলে ঢুকে ঘুরতাম। শুনতে পেতাম কত রকম নাম না জানা পাখির ডাক।
এখনও আমি সেই ডাক শুনি। এই শহরে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে, গাড়ির হর্নের মধ্যেও আমি ডুয়ার্সের সেই পাখিগুলোর ডাক শুনতে পাই। নগরজীবনের শব্দ-সমারোহেও ওই ডাকই আমার পড়শি।