নবগ্রামের সেই থমথমে ভাব কাটল না চার বছর পরেও

রক্ত মুছে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে থমথমে ভাব। ২০১০-এর জুনে তিন ভাই খুনের রেশ চার বছরেও মোছেনি লাভপুরের নবগ্রামের গা থেকে। সে সময়ের দাপুটে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা (এখন লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক) মনিরুল ইসলামের বাড়িতে ডাকা সালিশিসভায় গিয়ে খুন হন তিন ভাইজাকের আলি, কোটন শেখ, ওইসুদ্দিন শেখ।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

লাভপুর শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০৩:০৯
Share:

লাভপুরের নবগ্রামে মনিরুল ইসলামের সেই বাড়ি। এখানেই সালিশি সভায় তিন ভাইকে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ছবি: সুমন বল্লভ।

রক্ত মুছে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে থমথমে ভাব। ২০১০-এর জুনে তিন ভাই খুনের রেশ চার বছরেও মোছেনি লাভপুরের নবগ্রামের গা থেকে।

Advertisement

সে সময়ের দাপুটে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা (এখন লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক) মনিরুল ইসলামের বাড়িতে ডাকা সালিশিসভায় গিয়ে খুন হন তিন ভাইজাকের আলি, কোটন শেখ, ওইসুদ্দিন শেখ। অভিযোগ, মনিরুলের নেতৃত্বে জাকের, কোটন এবং ওইসুদ্দিনকে পিটিয়ে ও বোমা মেরে বিধায়কের বাড়ির উঠোনেই খুন করা হয়।

নবগ্রামের মাঝ বরাবর জাকেরদের বাড়ি। তাঁরা ন’ভাই। ন’জনের ন’টা বাড়িই এখন পরিত্যক্ত। হত্যাকাণ্ডের প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গ্রামের ভিটে ছাড়েন অন্য ছ’ভাই (তাঁদের মধ্যে তিন জন হামলায় আহতও হয়েছিলেন)। আস্তে আস্তে এলাকা ছেড়েছে নয় ভাইয়ের পরিবারও। সালিশিসভায় হাজির থাকা সানোয়ার শেখের দাবি, “মনিরুলের লোকদের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে। আসার সময় শুধু পরনের কাপড়টুকুই সম্বল ছিল আমাদের। অনেক কষ্টে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছি। পরিবারকেও গ্রামে টিকতে দেয়নি ওরা।”

Advertisement

নবগ্রামে সানোয়ার শেখের বাড়ির গ্রিলের গেটে মরচে পড়েছে। কোটন শেখের বাড়ির উঠোনে টিউবয়েল থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে হ্যান্ডেল। দু’পা এগিয়ে জামাল শেখের বারান্দায় হাঁস রাখার জায়গায় ধুলোমাখা পালক পড়ে। বাকি ভাইদের বাড়িগুলো চেহারার দিক থেকে যেন একে-অন্যের ফটো-কপি। সব ক’টারই সদর দরজায় তালা।

চার বছর আগে তিন ভাইয়ের দেহ পাওয়া গিয়েছিল বিধায়কের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বের ফাঁকা জমিতে। তিন ভাই খুন হন রাতে। পর দিন সকালে তাঁদের রক্ত আঠার মতো হয়ে লেগেছিল ওই জমির ঘাস, খড়-কুটোয়। এখন সেখানে ডাঁই করে রাখা রয়েছে বালি।

কাকতালীয়ই হবে! কিন্তু মনে পড়িয়ে দেয়, এ গ্রামে রক্তের স্রোত বয়েছিল বালির, থুড়ি বালি-ঘাটের দখল নিয়েই। দীর্ঘদিন ধরে লাগোয়া ময়ূরাক্ষী নদীর কয়েকটি বালিঘাটের দখল নিয়ে দুই দলের (সিপিএম বনাম ফরওয়ার্ড ব্লক) বিবাদ ছিল। নিহতদের পরিবার সিপিএম সমর্থক। মনিরুল অন্য দলের নেতা। দু’পক্ষের বিবাদে এক সময় বালি-ঘাট বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। দু’পক্ষই ক্ষতির মুখে পড়ে। ২০১০-এর ৩ জুন নবগ্রামে বিধায়কের বাড়ির উঠোনে বৈঠক ছিল, সে সমস্যা মেটাতেই।

শুক্রবার বিধায়কের বাড়ির দরজার ফাঁক দিয়ে উঠোনে দেখা গেল এক মাঝবয়সী মহিলাকে। কড়া নেড়ে কথা বলতে যেতেই তিনি চলে গেলেন ভিতরে। বহু ডাকাডাকি, অনুরোধেও আর সামনে এলেন না। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিধায়ক হওয়ার আগে মনিরুল যে দু’টি সাদা গাড়ি ব্যবহার করতেন, সেগুলো। তাদের গায়ে ধুলোর চাদর।


সে দিনের সেই সালিশি সভায় হাজির ছিলেন সানোয়ার শেখ।—নিজস্ব চিত্র।

পাশেই মসজিদ সংস্কারের কাজ চলছে। সেখানে হাজির কিছু স্থানীয় বাসিন্দা জানালেন, চার বছর আগের ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ওই বাড়িতে স্থায়ী ভাবে কেউ থাকেন না। যে মহিলাকে এ দিন দেখা গিয়েছে, তিনি বিধায়কের দাদার পরিবারের সদস্যা। লাগোয়া বাড়িতে থাকেন। মাঝেমধ্যে ওই পরিবারের লোকজনই বিধায়কের বাড়ির ভিতরে আসা-যাওয়া করেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন গ্রামবাসী বললেন, “চার বছর আগের ওই ঘটনার পর থেকে বিধায়ককেও এখানে থাকতে দেখিনি। কাজে এ দিকে এলে কখনও-সখনও ও বাড়িতে যান। কখনও যানও না।”

এখনও কেন গ্রামে ফিরতে পারলেন না গ্রাম-ছাড়া ছ’ভাইয়ের পরিবার? এ বার নানা বয়সের ভিড় থেকে রীতিমতো চড়া গলায় জবাব এল, “সেটা ওই পরিবারগুলোই বলতে পারবে। আমরা কাউকে তাড়িয়ে দিইনি। কোনও অত্যাচারও করিনি।” গ্রামে নিহতদের পরিবারের যে আত্মীয়েরা আছেন, তাঁরা শুধু বলেছেন, “এ ব্যাপারে আমাদের জড়াবেন না।”

সানোয়ারের আক্ষেপ, “বাপ-ঠাকুরদার ভিটেতে ফিরতে না পারায় অস্বস্তি বোধ হয় যাওয়ার নয়। এ জমানায় বোধ হয় ফেরা হবে না!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন