বিসিএসের বাছাই প্রক্রিয়ায় গুরুতর অস্বচ্ছতার অভিযোগের জল শেষ পর্যন্ত গড়াল পিএসসি চেয়ারম্যানের ইস্তফায়। একই সঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ ঘিরেও খুলে গিয়েছে বিতর্কের দরজা। প্রথা ভেঙে কমিশনের মাথায় এ বার যাঁকে আনা হয়েছে, তিনি প্রোমোটি আইএএস। পিএসসি’র মতো মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এটা আদৌ মানানসই নয় বলে মনে করছেন প্রশাসনের একাংশ।
সরকারি সূত্রের খবর: প্রবীণ আইএএস অফিসার নুরুল হক পিএসসি’র চেয়ারম্যান পদে তাঁর ইস্তফাপত্র রাজভবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সপ্তাহ তিনেক আগে। তার পরে তিনি আর অফিসে যাননি। বৃহস্পতিবার রাজ্যপাল তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। নুরুল হকের এখনও বছরখানেক চাকরি বাকি ছিল। ইস্তফা দিলেন কেন?
নুরুল এ দিন মুখ খুলতে চাননি। যদিও নবান্ন-সূত্রের ইঙ্গিত, ডব্লিউবিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি বিশদ তথ্য (প্রেসি শিট) ইন্টারভিউয়ের আগেই হাতে চেয়ে কমিশনের দুই সদস্য তাঁর উপরে যে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, তারই জেরে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে তিনি পদ ছেড়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ দিন বিধানসভায় বলেন, “পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন। এটা ওঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। স্বশাসিত সংস্থার ব্যাপারে সরকারের কিছু করার নেই। তবে নতুন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশন নিয়ম মেনেই চলবে, কাজ করবে।” সেই মতো এ দিনই কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান পদে অবসরপ্রাপ্ত আইএএস শহিদুল ইসলামকে নিয়োগ করেছেন রাজ্যপাল। ১ মার্চ তিনি দায়িত্ব নেবেন। তবে সিদ্ধান্তটি ঘিরে গোড়াতেই উঠে গিয়েছে একরাশ বিতর্ক। কী রকম?
নবান্নের আমলামহলের বড় অংশের বক্তব্য: পিএসসি একটি স্বশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এর স্বতন্ত্র মর্যাদা রয়েছে। এমন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বরাবর রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের কোনও অফিসারকেই নিয়োগ করাই রীতি, যা কিনা এ বার লঙ্ঘিত হল। “পিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার অফিসারদের নিয়োগ করাটাই প্রথা। যার মানে, ওঁরা যে কেউ মুখ্যসচিব হতে পারেন।” মন্তব্য এক আধিকারিকের।
নুরুল হক কিংবা তাঁর পূর্বতন পিএসসি চেয়ারম্যানেরা, যেমন সব্যসাচী সেন, গৌরী চট্টোপাধ্যায়, সৌরীন রায় প্রমুখ তেমনই পদমর্যাদার আইএএস অফিসার ছিলেন। সে জায়গায় শহিদুল ইসলাম আদতে ডব্লিউবিসিএস (এগজিকিউটিভ) অফিসার, পদোন্নতি পেয়ে আইএএস (প্রোমোটি) হয়েছেন। এমতাবস্থায় প্রত্যাশিত ভাবেই প্রশাসনের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে। নবান্নের এক কর্তার আক্ষেপ, “এই জমানায় মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেই শেষ কথা। প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বা রীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।”
বস্তুত সাম্প্রতিক অতীতে অবাঞ্ছিত প্রথাভঙ্গের এমন আরও কিছু নজির পশ্চিমবঙ্গে দেখা গিয়েছে। যেমন, আইএএস মীরা পাণ্ডে অবসর নেওয়ার পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে এক জন ডব্লিউবিসিএস’কে। প্রশাসনের একাংশের অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এ সব করা হচ্ছে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন বা মহিলা কমিশনের মতো স্বাধীন সংস্থাগুলোকেও কার্যত অচল করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। “যে কারণে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা ঘটনা ঘটলেও তাদের সে ভাবে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে না।” পর্যবেক্ষণ এক অফিসারের।
নুরুল-বিদায়ের পিছনে ঠিক কী ঘটনা? পিএসসি-সূত্রের খবর, নুরুল দায়িত্ব নেওয়া ইস্তক তাঁর উপরে নানা ভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। ২০১২-র ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষার পরে রাজ্যের এক মন্ত্রী বিশেষ কয়েক জন প্রার্থীর নাম প্যানেলে রাখার সুপারিশ করেছিলেন। চেয়ারম্যান রাজি হননি। টানাপড়েনের জেরে সে বছর পরীক্ষার ফল প্রকাশই বছরখানেক পিছিয়ে যায়। এ ছাড়া নানা সময়ে নানান ‘প্রভাবশালী’ মহল থেকে হরেক সুপারিশ এসেছে। নুরুল কোনওটাই মানেননি। উল্টে মুখ্যসচিবকে সব জানিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি চরমে ওঠে গত বছরের শেষাশেষি, যার মূলে কমিশনের দুই সদস্যের নিরন্তর চাপ। কী রকম?
কমিশন-সূত্রের খবর, ডব্লিউবিসিএসের ইন্টারভিউয়ের সাত দিন আগে প্রার্থীদের ‘প্রেসি শিট’ বোর্ড সদস্যদের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পিএসসি। প্রশাসনের ভিতরে-বাইরে তুমুল প্রতিবাদ ওঠে। এমনটা হলে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে আগাম যোগাযোগ করে টাকার লেনদেন ও রাজনৈতিক আনুগত্য যাচাইয়ের পথ খোলা থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন মহল। শেষমেশ কমিশন-কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তটি বাতিল করেন। কমিশনের গোপন নোটে এ-ও উল্লেখ করা হয় যে, রীতিমতো চাপের মুখে পড়েই আগের নির্দেশটি দেওয়া হয়েছিল।
আর তা নিয়েই চেয়ারম্যানের সঙ্গে কমিশনের ওই দুই বোর্ড সদস্যের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। খবরটি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হতেই বীতশ্রদ্ধ চেয়ারম্যান মুখ্যসচিবের কাছে ইস্তফার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তখন সরকারের তরফে তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, ‘রাজনীতি-সূত্রে’ কমিশনে নিযুক্তদের সরিয়ে দেওয়া হবে। তা হয়নি। ফলে নুরুল হক নিজেই সরে গেলেন বলে কমিশন-সূত্রের দাবি।
পিএসসি-র পরিচালন বোর্ডের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। চেয়ারম্যান ছাড়া বাকিরা হলেন পূর্ত দফতরের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ ননীগোপাল মুখোপাধ্যায়, অবসরপ্রাপ্ত ডব্লিউবিসিএস এসএস সরকার এবং দুই মনোনীত সদস্য দেবপ্রিয় মল্লিক ও দীপঙ্কর দাশগুপ্ত। চিকিৎসক তথা সমাজকর্মী দেবপ্রিয়বাবু রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাদা। আর দীপঙ্করবাবু এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় উচ্চপদে কাজ করতেন, যার সূত্রে শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা।
নতুন চেয়ারম্যান কার্যভার না নেওয়া পর্যন্ত দেবপ্রিয়বাবুর হাতেই কমিশনের দায়িত্বভার ন্যস্ত করা হয়েছে।