পার্ক রক্ষায় বহু পদ, অরণ্য অরক্ষিতই

শূন্য-পদের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে গেলেও পালাবদলের পরে বন দফতরে নতুন নিয়োগ থমকেই রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘অ্যানিম্যাল পার্ক’ অবশ্য সেই তালিকায় পড়ছে না। শিলিগুড়ির অদূরে ওই পার্কের জন্য ৬০টি নতুন পদ তৈরি করে ইতিমধ্যেই তা অর্থ দফতরের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩০
Share:

পার্কে আনা হয়েছে হরিণ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

শূন্য-পদের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে গেলেও পালাবদলের পরে বন দফতরে নতুন নিয়োগ থমকেই রয়েছে।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘অ্যানিম্যাল পার্ক’ অবশ্য সেই তালিকায় পড়ছে না। শিলিগুড়ির অদূরে ওই পার্কের জন্য ৬০টি নতুন পদ তৈরি করে ইতিমধ্যেই তা অর্থ দফতরের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের গোড়ায় শিলিগুড়ি এসে মুখ্যমন্ত্রীর ওই পার্কের উদ্বোধনের আগে পদ-পূরণ যে নেহাতই সময়ের অপেক্ষা, বনকর্তারা তা মেনেও নিয়েছেন।

আগামী মার্চ মাস থেকেই ওই নয়া পদ-পূরণ শুরু হওয়ার কথা। প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই— বন প্রহরা না কি সাধের ‘অ্যানিম্যাল পার্ক’, নিয়োগ প্রশ্নে প্রাধান্য পাবে কোনটি?

Advertisement

পার্কের দেখভাল ও তদারকির জন্য ইতিমধ্যেই নিয়োগ করা হয়েছে ডিএফও পদ মর্যাদার এক অফিসারকে। দু’জন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে ঢেলে সাজছে পার্ক। রয়েছেন আরও অন্তত ১৫ জন কর্মী। যাঁদের বেতন বাবদ মাসিক প্রায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে সরকারের।

এর বিপরীতের ছবিটা কী রকম? বিরোধীদের দাবি—উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রহরাহীন জঙ্গলে চোরাশিকারির আনাগোনা নতুন নয়। গত তিন বছরে তাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে, অন্তত ৯টি গন্ডার, ১১টি হাতি। মারা গিয়েছে বেশ কয়েকটি চিতাবাঘ, হরিণ, ময়ূরও। তা সত্ত্বেও বনকর্মী নিয়োগ না করে মুখ্যমন্ত্রীর ‘ড্রিম প্রোজেক্ট’ বা স্বপ্নের প্রকল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে কেন? বনকর্তাদের কাছে এর কোনও উত্তর মেলেনি।

একনজরে অ্যানিম্যাল পার্ক

শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব: ৮ কিমি। প্রথম পর্যায় উদ্বোধন: জানুয়ারি ২০১৬। মোট এলাকা: ৩০০ হেক্টর।

বাজেট: ২৫৫ কোটি টাকা কল্পের সময়সীমা: ৫ বছর।

সাফারি: বাস, ব্যাটারি গাড়ি ও হাতি সাফারি।

জন্তু: হরিণ, গন্ডার, বাইসন, বাঘ, চিতাবাঘ, নানা প্রজাতির পাখি, ভাল্লুক, বুনো শুয়োর, বিভিন্ন প্রজাতির লেসার ক্যাট।

তারজালির খাঁচা তৈরি শেষ। গাছ লাগানো, রাস্তা তৈরি অন্যান্য কাজও শেষের পথে। নতুন ঠিকানায় একে একে এসে পড়েছে— চিতল, সম্বর, মৃগনাভির দল। আনা হয়েছে তিন প্রজাতির বাঁদর। আর একটু সেজেগুজে উঠলেই তিস্তার চরে একলা ঘুরে বেড়ানো গন্ডারটিকেও (যার সঙ্গীটি দিন কয়েক আগেই চোরাশিকারির গুলিতে মারা গিয়েছে) ধরে বেঁধে এনে ঢোকানো হবে এই তারজালির ঘেরাটোপে। আসবে হাতি। এমনকী ডুয়ার্সের গাঁ-গঞ্জে ধরা পড়া চিতাবাঘেরাও।

তার পরেই, বছরের গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রী এসে ফিতে কেটে উদ্বোধনের কাজটুকুও সেরে ফেলে শিলিগুড়ির মুকুটে নব্য পালক গুঁজে দেবেন। বিরোধীরা বলছেন, শিলিগুড়ি পুরসভা হাতছাড়া হওয়ার পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মন পেতে মুখ্যমন্ত্রীর এই মরিয়া উদ্যোগ।

কিন্তু যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রাজসূয় খরচে এই পার্ক গড়ার কোনও প্রয়োজন ছিল কি?

ক্রমান্বয়ে বনাঞ্চল হ্রাস পেলেও উত্তরবঙ্গ বিস্তীর্ণ ডুয়ার্স জুড়ে জল-জঙ্গলের অভাব নেই এখনও। বস্তুত, রাজ্যের ১৪ শতাংশ বনাঞ্চলের সিংহভাগই এই অঞ্চলে। বন্য পশুর অভাবও সেখানে নেহাত কম নয়। গ্রীষ্ম-শীতে পর্যটকের ঢলেও ভাঁটা নেই। তা হলে নতুন করে এই ‘অ্যানিম্যাল পার্ক’ গড়ার কারণ কী? শাসক দলের অন্দরমহলের খবর— বিধানসভা নির্বাচনের মুখে উত্তরবঙ্গকে ঢেলে সাজতেই এই উদ্যোগ। দলের এক তাবড় নেতার কথায়, ‘‘সাধ্য না থাকলেও মুখ্যমন্ত্রীর সাধের প্রকল্প বলে কথা!’’

শনিবার থেকে পার্কে বন্য জন্তুদের ছাড়ার কাজ শুরু হয়েছে। আপাতত শিলিগুড়ির শালুগাড়া লাগোয়া নির্মিয়মাণ ওই পার্কে কোচবিহারের কুঞ্জনগর এবং দার্জিলিং চিড়িয়াখানা থেকে হরিণের পালগুলিকে আনা হয়েছে। রবিবারে সংখ্যাটা দাঁড়াল ৩২-এর কাছাকাছি। কিছু দিনের মধ্যেই ডুয়ার্সের জলদাপাড়া এবং মালদার আদিনা থেকে বার্কিং ডিয়ার, চিতল হরিণ এবং বড় শিং প্রজাতির হরিণ আনা হবে। নতুন পরিবেশে হরিণের দল যাতে মানিয়ে নিতে পারে, তাই আপাতত ২ হেক্টর জায়গায় প্রাকৃতিক ঘেরাটোপে রাখা হচ্ছে তাদের। তাদের খাওয়ার হিসেবে গাছগাছালির সঙ্গে থাকছে প্রোটিন ফুড খাওয়ানোর ব্যবস্থাও। পার্কের সম্প্রসারণের সঙ্গে এক এক করে আসবে বাইসন, গন্ডার।

২০১৩ সালে জঙ্গলের পরিবেশে পার্ক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল রাজ্য সরকার।

শালুগাড়া এবং সেবকের মাঝে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের মাঝে প্রায় ৩০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে ওই পার্ক গড়ার অনুমোদন দেয় সেন্ট্রাল জু অথরিটি। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই পার্কটির শিলান্যাস করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের বন দফতর ও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ যৌথ ভাবে প্রকল্পটির দায়িত্ব নেয়। জঙ্গল, নদী, মাটির ঢিপির স্বাভাবিক পরিবেশ রেখে বড় বড় এলাকা দেওয়াল ও তারজালি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক ভবন, পার্কিং লট, রেস্তোরাঁ, কর্মী-আবাসন, পাওয়ার স্টেশন। থাকছে উন্নত পরিকাঠামোযুক্ত পশু হাসপাতালও।

থাকছে ইলেকট্রিক ফেন্সিং-এর ব্যবস্থা। প্রথমে বাস এবং পরে হাতির মাধ্যমে সাফারি হবে। তার পর শুরু হবে ছোট সাফারি বাস বা ব্যাটারি গাড়িতে সাফারি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন