বিবেকের পরে চৈতন্যের উদয়!
শাসক দলে একের পর এক নেতা-নেত্রীরা বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে নানা প্রশ্নে সরব হচ্ছেন। আর ঠিক এই সময়েই যাত্রার মঞ্চে শ্রীচৈতন্যের ভূমিকায় নামছেন বর্ধমানের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ।
বর্ধমানের পূর্বস্থলী দক্ষিণের বিধায়ক স্বপন দেবনাথের এখন দুই রূপ। এক দিকে তিনি ডাকসাইটে তৃণমূল নেতা। রাজ্যের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প এবং পশুপালন মন্ত্রী। অকপটে যিনি দাবি করতে পারেন, ‘সিপিএমের নেত্রীরা ব্লাউজ ছিঁড়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন!’
অন্য দিকে মঞ্চে নিমাই রূপে তিনিই বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলেন, “প্রেম হবে অস্ত্র আমাদের। কাঁদিয়া কাঁদাতে হবে, জনগণ মানিয়া লবে, প্রেম বিনে গতি নয় আর।” নারদের কাছে নারায়ণ-রূপে তিনিই যখন শোনেন, ‘মর্ত্যে আজ অধর্ম হচ্ছে’, তাঁর হৃদয় উদ্বেলিত হয়। নারায়ণ থেকে তাঁকে হতে হয় শ্রীচৈতন্য!
কী বৈপরীত্য! স্বপনবাবুর নিজের কাছে বিষয়টা খুব বিপরীতধর্মী হয়ে থাকেনি। তাঁর দাবি, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খারাপ কথা কখনও বলেননি তিনি। তাঁর বক্তব্য, “চৈতন্যও সাম্যবাদের আন্দোলন করতেন, আমরাও তাই করি। মমতাদিও মানুষকে কাছে টানার কথাই বলেন!” মমতাদির সেনানী হয়েই তাই যাত্রার মঞ্চে অভিনয় করছেন মন্ত্রী ‘স্বপন-কুমার’। তাঁর বিশ্বাস, “যাত্রায় লোকশিক্ষা হয়। মানুষের চেতনা বাড়ে।”
যাত্রার শখ স্বপনবাবুর আজকের নয়। যাত্রাশিল্পের কিংবদন্তি মতিলাল রায় ছিলেন তাঁর এলাকার লোক। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই যাত্রা করছেন স্বপন। তাঁর দু’টি শৌখিন যাত্রাদল আছে। একটি তাঁর গ্রাম বিদ্যানগরে। সেই দলের নাম ‘শ্রীচৈতন্য নাট্যসমাজ’। এই দলের হিট পালার একটি ‘নাচমহল’, অন্যটি ‘পালকি-ভাঙা বউ’। ওই দলটিকে দিয়ে এ বার যুব উৎসবে নাটক করিয়েছেন স্বপনবাবু। এখন নতুন একটি দলেও তিনি অভিনয় করছেন। বাগনাপাড়ার ‘মা আনন্দময়ী যাত্রা অপেরা।’ সেই দলের ‘ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া’ পালাতেই নিমাই সেজে যাত্রা উৎসবের মঞ্চে নামছেন স্বপনবাবু। কাল, শুক্রবার সন্ধ্যায় বাগবাজারের ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ মঞ্চে এ পালার দ্বিতীয় অভিনয়।
রাজনীতিকদের অভিনয়ে আসার উদাহরণ এ রাজ্যে খুব বেশি না হলেও অপ্রতুল নয়। কংগ্রেসের সাংসদ, প্রয়াত অজিত পাঁজা মঞ্চে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বর্তমান পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় নয়ের দশকের শুরুতে ‘চৌধুরী ফার্মাসিউটিক্যালস’ নামে একটি দূরদর্শন ধারাবাহিকে মুনমুন সেনের সঙ্গে অভিনয় করতেন। তখন তিনি জোড়াবাগানের কংগ্রেস বিধায়ক। বাম জমানায় দমকলমন্ত্রী প্রতিম চট্টোপাধ্যায় সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। বর্তমান সরকারের জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রও একটি ছবি করেছেন।
তা ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে এমনিতেই অভিনেতা-অভিনেত্রীর ছড়াছড়ি। ব্রাত্য বসু বা অর্পিতা ঘোষের মতো নাট্যব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে দেব-মুনমুন-মিঠুন-তাপস-শতাব্দী-দেবশ্রী-চিরঞ্জিতরা এই দলের টিকিটেই বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী হয়েছেন। সাংসদ হওয়ার পরেও তাপস-শতাব্দী জুটি বেঁধে যাত্রামঞ্চ কাঁপিয়েছেন।
স্বপনবাবু শৌখিন অভিনয়েই নিজেকে বেঁধে রাখছেন। বুধবার পানাগড়ে মাটি উৎসবে যোগ দিতে যাওয়ার পথেই গাড়িতে পালার সংলাপ ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন। গলা তুলে-নামিয়ে শোনাচ্ছিলেন, ‘শিব আছে সতী মাথায়, কী আমার অপরাধ?’
যাত্রা-পাগল স্বপনবাবু ইতিমধ্যেই তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রের রাজপুর-ভাটশালা গ্রামে এবং ন’পাড়া গ্রামে দু’টি যাত্রা মঞ্চ তৈরি করিয়েছেন। স্বপনবাবুর কথায়, আজকাল টিভি সিরিয়ালের দাপটে যাত্রা অনেকটা ধাক্কা খেয়েছে। “কিন্তু মমতাদি আমাদের যাত্রাশিল্পকে নানা ভাবে সহযোগিতা করছেন। যাত্রাকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।”
বিরোধীরা অবশ্য কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না! সিপিএমের নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর মন্তব্য, “পার্টিটাই তো যাত্রা পার্টি। সরকারের ভেতরে, বাইরে যাত্রা পালাই চলছে!” আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, “চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় করে যেন ওঁদের চৈতন্যের উদয় হয়, এই প্রার্থনাই করি।”