ক্ষমতায় এসেই শিক্ষার আঙিনাকে রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করার কথা বারবার বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে রাজনীতিকে দূরে রেখে শিক্ষাবিদদের নিয়ে প্রেসিডেন্সির জন্য মেন্টর গ্রুপ গড়েছিলেন তিনিই। এ বার তাঁর দলের হয়ে লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন সেই মেন্টর গ্রুপেরই চেয়ারম্যান, ইতিহাসের অধ্যাপক সুগত বসু। শিক্ষাবিদের এ ভাবে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠছে, তৃণমূল প্রার্থী সুগতবাবুর কি আর মেন্টর গ্রুপে আদৌ থাকা উচিত?
প্রশ্ন যে উঠছে, তার কারণ, শাসক দলের টিকিটে সাংসদ হওয়ার দৌড়ে নামার পরেও সুগতবাবু কতটা অরাজনৈতিক ভাবে কাজ করতে পারবেন, তার উপরে নির্ভর করছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন। আবার প্রেসিডেন্সির জন্য রাজনীতির প্রভাব-বর্জিত উপাচার্য বাছাই নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ, সুগতবাবু প্রেসিডেন্সির প্রথম স্থায়ী উপাচার্য বাছাইয়ের জন্য গঠিত সার্চ বা সন্ধান কমিটিরও সদস্য। প্রশ্ন উঠছে, ভোটে প্রার্থী হওয়ায় সেই দায়িত্ব থেকেও তাঁর সরে দাঁড়ানো উচিত কি না?
শিক্ষাবিদদের অনেকের মতে, মেন্টর গ্রুপ ও সন্ধান কমিটি থেকে ইস্তফাই দেওয়া উচিত সুগতবাবুর। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, সুগতবাবুর নির্বাচনে লড়াইয়ের বিষয়টি যদি তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে প্রভাব ফেলে, তখনই ইস্তফা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।
সুগতবাবু নিজে কী ভাবছেন?
মেন্টর গ্রুপের প্রধান জানান, সব দিক বিচার করে ওই দুই পদে থাকা বা না-থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। এবং সিদ্ধান্ত জানাবেন মনোনয়নপত্র পেশ করার আগেই।
সুগতবাবু মঙ্গলবার বলেন, “আমি গত সওয়া তিন বছরে প্রেসিডেন্সির উন্নয়নের জন্য অনেক ইতিবাচক কাজ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির কথা মাথায় রেখে এবং সকলের সঙ্গে পরামর্শ করেই ওই দুই পদে থাকা বা না-থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।” তবে সুগতবাবুর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, প্রেসিডেন্সিতে তাঁর কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ না-করে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির পথে বাধা তৈরি করতে চান না এই অধ্যাপক। ওই দুই পদে থাকার জন্য সুগতবাবু কোনও সাম্মানিক পান না। তাই মেন্টর গ্রুপ ও সন্ধান কমিটি থেকে তাঁর ইস্তফা দেওয়াটা নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী বাধ্যতামূলকও নয়।
কিন্তু প্রেসিডেন্সি-কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থা নেবেন কি?
প্রেসিডেন্সির উপাচার্য মালবিকা সরকার জানান, মেন্টর গ্রুপ বা সার্চ কমিটি তৈরি করা তাঁদের কাজ নয়। তাঁরা তা করেনওনি। তাই সুগতবাবুর ইস্তফা দেবেন কি দায়িত্বে থেকে যাবেন, সেই ব্যাপারে কিছু বলতে চান না তিনি। আর শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কথায়, “প্রাথমিক ভাবে বলতে পারি, আমি যত দূর জানি, বিষয়টি বেআইনি নয়। বিস্তারিত ভাবে জেনে এ বিষয়ে আরও কথা বলতে পারব।”
বিষয়টি বেআইনি নয় বলে মন্ত্রী মন্তব্য করলেও শিক্ষাজগতের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত অনেকের প্রশ্ন, নিয়মবিধিতে হয়তো আটকাবে না। কিন্তু লোকসভার প্রার্থী সুগতবাবু মেন্টর গ্রুপ আর সন্ধান কমিটির পদে থেকে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে প্রেসিডেন্সির উন্নয়ন সম্ভব হবে কি?
প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী, বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বলেন, “মূল ধারার রাজনীতিতে ঢুকে পড়ার পরেও কেউ যদি এ ধরনের পদে থাকেন, তা হলে নির্বাচন কমিশনের মূল নীতিটাই লঙ্ঘন করা হয়। কারণ, ওই পদের জোরেই তিনি কিছু ভোট পেতে পারেন। তাই সুগত বসুর এখনই ওই সব দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়া উচিত।” আইআইএম জোকার অর্থনীতির অধ্যাপক অনুপ সিংহের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “আমি সুগত বসুর জায়গায় থাকলে ওই সব পদ থেকে ইস্তফা দিতাম।”
সুগতবাবু এখনই ইস্তফা দিন, প্রেসিডেন্সির সঙ্গে যুক্ত অনেক শিক্ষক তা চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ডিন, পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সোমক রায়চৌধুরী বলেন, “প্রেসিডেন্সিকে বর্তমান চেহারা দেওয়ার পিছনে সুগতবাবুর অবদান অনস্বীকার্য। তবে ভবিষ্যতে যদি দেখা যায়, তিনি রাজনীতি আর কর্মক্ষেত্র আলাদা করতে পারছেন না, তখন আমরাই ওঁকে পদত্যাগ করতে বলব।” মেন্টর গ্রুপের অন্যতম সদস্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তীও মনে করেন, এখনই এই ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় আসেনি। “সুগতবাবুর কাজ নিয়ে কোনও সমস্যা হলে তখন দেখা যাবে,” বললেন তিনি।
তবে সুগতবাবুর সরে দাঁড়ানোর পক্ষে অনেক শিক্ষকই। এবং শুধু শিক্ষকসমাজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী সুগতবাবুর যুক্ত থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের মধ্যেও। এ ব্যাপারে সহপাঠীদের মতামত জানতে ছাত্র সংসদ আজ, বুধবার ও কাল, বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে গণভোটের ব্যবস্থা করেছে। ছাত্র সংসদের সভাপতি সুমাল্য মুখোপাধ্যায় বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের পদগুলিতে সুগত বসুর থাকা উচিত কি না, এই প্রশ্নে ভোট হবে। রায় ওঁর পদ ছাড়ার পক্ষে গেলে সেটা ওঁকে জানাব। উনি না-মানলে সুগতবাবুর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হবে।”
এই ভোটাভুটি নিয়ে সুগতবাবু অবশ্য কিছু বলতে চাননি।