ঘটকপুকুরে প্রচারে সুজন চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।
লোকসভা ভোটের প্রচারে নেমে বহিষ্কৃত সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লার কাছে সমর্থন চাইলেন সুজন চক্রবর্তী। সুজনবাবু একাধারে দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক এবং যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী। তিনি রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও বটে। তাঁর এ ভাবে সমর্থন চাওয়া নিয়ে আলিমুদ্দিনের নেতাদের মুখে শোনা গিয়েছে দু’রকম সুর।
যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অধীন ভাঙড় বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রচারের ফাঁকে শনিবার সুজনবাবু বলেন, “রেজ্জাকদার মতো অভিজ্ঞ বর্ষীয়ান নেতা রাজ্যের পরিস্থিতি অনেক ভাল জানেন, বোঝেন। তাই আমি সৌজন্যমূলক ভাবে ওঁর সমর্থন চাইছি।” যা শুনে এ দিনই বেথুয়াডহরিতে রেজ্জাক বলেন, “আমি তো আর সিপিএম নই। সিপিএম যদি কোনও অ-সিপিএমের কাছে সাহায্য চায়, তবে প্রস্তাব দিক। আগে তো নিমন্ত্রণ করুক। তার পরে ভাবব খাব কি না। পেট খারাপ থাকলে খাব না।”
ঘনিষ্ঠ মহলে রেজ্জাক অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ‘সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চ’-এর হয়েই তিনি আপাতত অনগ্রসরদের অধিকারের দাবিতে প্রচার করবেন। কোনও দলের নির্বাচনী প্রচার করবেন না। বস্তুত,এ দিন বেথুয়াডহরিতে একটি অনগ্রসর শ্রেণির সংগঠনের কর্মিসভাতেই গিয়েছিলেন রেজ্জাক। ১৯ মার্চ তিনি বসিরহাটে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীদের একটি কনভেনশনে যোগ দেবেন। সেটিও সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে।
সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক হিসেবে ভাঙড়-ক্যানিং এলাকায় রেজ্জাকের অনুপস্থিতির প্রভাবের ব্যাপারে সুজনবাবু সম্যক অবহিত। যাদবপুরের প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা হওয়ার পরেই তাঁর বক্তব্য ছিল রেজ্জাকের সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক ৪৫ বছরের। তাঁর মতো নেতা না থাকায় কিছু এলাকায় শূন্যস্থান থাকবেই। সেটা মেনে নিয়েই ভোটের প্রচারে নামতে হবে। এর পরে যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী সুজনবাবু এবং জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের (ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীন) আরএসপি প্রার্থী সুভাষ নস্কর রেজ্জাককে ফোন করে আর্জি জানিয়েছিলেন, প্রবীণ ওই বহিষ্কৃত বিধায়কের সমর্থকেরা যেন তৃণমূল বা অন্য কোনও দলকে সমর্থন না করেন।
বস্তুত, ভাঙড়-ক্যানিং এলাকায় সিপিএমকে বহু ভোট-যুদ্ধ পার করিয়েছেন রেজ্জাক। কিন্তু এ বার ভোটের দিন ক্ষণ ঘোষণা হওয়ার পরে ওই দুই এলাকায় তৃণমূল-বিজেপি প্রচার শুরু করে দিলেও এত দিন রেজ্জাকহীন সিপিএমকে দেখা যায়নি। ভাঙড়ে এখনও পর্যন্ত দেওয়াল-লিখনও সে ভাবে করতে পারেনি সিপিএম। শনিবারই ওই এলাকায় তারা প্রথম প্রচার শুরু করে সুজনবাবুকে নিয়ে। সুজনবাবুর সঙ্গে ছিলেন মাত্র শ’খানেক কর্মী-সমর্থক (এ দিনের কর্মসূচিতে সাড়া দেওয়ার জন্য সুজনবাবু ট্যুইট করে মানুষকে ধন্যবাদও জানান)। সুজনবাবু নিজেই স্বীকার করেছেন, রেজ্জাক মোল্লা না থাকায় তাঁর খারাপ লাগছে। সুজনবাবু বলেন, “গত লোকসভা ভোটে রেজ্জাকদা আমাদের সঙ্গে ছিলেন ঠিকই। এ বার তিনি আমাদের সঙ্গে নেই। খারাপ লাগলেও এ কথা সত্যি। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে দল তাঁকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে। তিনিও চাইছিলেন, দল একটা সিদ্ধান্ত নিক।”
রাজ্য সিপিএম নেতৃত্বের কেউ অবশ্য রেজ্জাকের প্রতি সুজনবাবুর আর্জি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খুলছেন না। তবে, আলিমুদ্দিনে এই নিয়ে দু’রকম মত রয়েছে। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “ভোটের প্রচারের সময়ে আমরা তৃণমূল-সহ অন্য বিরোধীদের কাছেও সমর্থন চাই। রেজ্জাকের সমর্থন চাওয়াকে আলাদা করে দেখার মানে হয় না।”
আবার, দলেরই অন্য একটি অংশ মনে করছে, সদ্য বহিষ্কৃত নেতার প্রতি এ ভাবে আবেদন জানালে নিজেদের তরফেই স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, রেজ্জাকের অভাব সাংগঠনিক ভাবে অনুভূত হচ্ছে। দলের এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, “ভাঙড়-ক্যানিং এলাকায় দীর্ঘদিনের নেতা রেজ্জাকের কিছু প্রভাব আছে জেনেও সচেতন ভাবেই তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার পরে এ ধরনের আর্জি এড়িয়ে চলাই ভাল।”
এ বার রেজ্জাক মোল্লার না থাকা যদি একটি প্রতিকূলতা হয়, তা হলে অন্য প্রতিকূলতা হিসেবে সুজনবাবু চিহ্নিত করেছেন ‘তৃণমূলের সন্ত্রাস’কে। সুজনবাবু বলেন, “ভাঙড়ে নেতা-কর্মীর সঙ্কট চলছে। আরাবুল তথা তৃণমূলের একটি সন্ত্রাসের পরিবেশ রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগছে প্রেসিডেন্সি কলেজের মেন্টর তথা প্রার্থী সুগত বসু ভাঙড়ে আরাবুলকে নিয়েই প্রচার করবেন। যে আরাবুল শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারেন, পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকে শিক্ষিকাকে হুমকি-কটূক্তি করেন। এই পরিস্থিতিতে আমরাও ধীরে চলার পক্ষপাতী। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ তো করতেই হবে। আমি আশাবাদী।” যাদবপুর কেন্দ্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর এ হেন মন্তব্য নিয়ে সুগতবাবুর অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে, তাঁর দলের তরফে বলা হয়, এই সব শ্লেষ বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ না করে সুজনবাবু বরং নিজের ‘ম্যাও’ সামলান।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম সূত্রে বলা হচ্ছে, যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে বারুইপুরের দু’টি এবং সোনারপুরের দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রে খানিকটা পিছিয়ে থেকে শুরু করতে হচ্ছে বামেদের। আবার কলকাতার উপকণ্ঠে টালিগঞ্জ এবং যাদবপুরেও তৃণমূল এগিয়ে। সেখানে ভাঙড়ের বিধায়ক সিপিএমেরই। যদিও, গত পঞ্চায়েত ভোটে রেজ্জাক থাকা সত্ত্বেও সিপিএম সুবিধা করতে পারেনি সেখানে। কিন্তু লোকসভার লড়াইয়ে ভাঙড়ে ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন সুজনবাবু। তাই রেজ্জাকের প্রতি ওই আর্জি।