সরাসরি ভোটগন্ধী একটি শব্দও খরচ হয়নি। কিন্তু এক স্লোগানে মিলে যাচ্ছেন ফোলিও ব্যাগধারী চাকুরিজীবী, মধ্যবিত্ত তরুণী, কিংবা বাস্কেটবল হাতে খেলা-পাগল তরুণ। সবারই এক কথা, “আমার পাড়ায় ছোড়দা!”
বিজ্ঞাপনের টিজার-এর আদলে এমন হোর্ডিংয়েই ভোট-প্রচারের গৌরচন্দ্রিকাটুকু সেরে ফেলছেন কলকাতা (উত্তর) কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী সোমেন মিত্র। যুবসমাজের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে রীতিমতো গাঁটের কড়ি খরচা করে একটি পেশাদার উপদেষ্টা সংস্থার সাহায্য নিয়েছেন তিনি। বলছেন, “যুবকদের মন জিততে ওদের ভাষায় কথা বলা রপ্ত করতে হবে!”
এই উপদেষ্টারাই আজকাল ভোটে অর্জুনের কৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন। এই মুহূর্তে এ রাজ্যের বিভিন্ন দলের অন্তত চার জন প্রার্থীর প্রচারের সহায়ক, একটি সংস্থার কর্তা (প্রার্থীদের সঙ্গে শর্তের দরুণ নাম প্রকাশে অপারগ) বলছেন, “দরকারে কোনও প্রার্থী কখন, কোথায়, কাকে কী বলবেন, কী পরবেন সেটাও ঠিক করে দিই।”
রাঢ়বঙ্গে শাসক দলের এক মহিলা প্রার্থী যেমন। তাঁকে নির্বাচনী কেন্দ্রের আঁতিপাতি চিনিয়ে মানুষের অভাব-অভিযোগ বুঝিয়ে প্রচারের বিষয়বস্তু সরবরাহ করতে হচ্ছে উপদেষ্টাকে। যাঁরা এই কাজ করছেন, সেই জনসংযোগ সংস্থার কর্তা অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় সহাস্যে বলছেন, “আমাদের ভূমিকা ওঁর জন্য অনেকটা নেটের গুগ্ল বা স্মার্টফোনের অ্যাপ্স-এর মতো। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া রেখে কাজ করছি।” অরিন্দমের দাবি, এটা নিছক বন্ধুকৃত্য। তবে দিল্লির বিধানসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী হর্ষবর্ধনের প্রচারে পেশাদার ভাবেই তাঁরা কাজ করেছেন। এ বারও দিল্লি ও বিহারের দু’জন প্রার্থীর সঙ্গে কথা চলছে।
মোদ্দা কথা, স্রেফ দল বা সংগঠনের ভরসাই সব নয়! পেশাদার সাহায্য নেওয়ার প্রবণতা এই ২০১৪-য় আরও জাঁকিয়ে বসছে পশ্চিমবঙ্গে। গোটা দেশের নিরিখে এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। রাহুল গাঁধী বা নরেন্দ্র মোদীর মতো হেভিওয়েটরা তো বটেই, আরও অনেক প্রার্থীকেই ছায়ার মতো অনুসরণ করে পেশাদার বিজ্ঞাপন সংস্থা কিংবা জনসংযোগের এজেন্সি। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং গুগ্ল-ইউটিউবের মতো নেট-মঞ্চে প্রার্থীকে উপস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছেন এমন পেশাদাররাই।
আবার প্রতিপক্ষ বেফাঁস কিছু বললে বা করলে সেটাও নেটে প্রচার করছেন তাঁরা। ভিন্ রাজ্যে কোথাও কোথাও ‘রাইভ্যাল মনিটরিং’-এর ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষের গতিবিধি, কথাবার্তর উপরে নজর রাখা। সেটা এ রাজ্যে ততটা এখনও শুরু হয়নি। তবে রাজনীতিতে আনকোরা, নির্দল থেকে শুরু করে পোড় খাওয়া নেতা-নেত্রী অনেকেই এখন পেশাদারি সাহায্যের গুরুত্ব মানতে শুরু করেছেন।
মালদহ (দক্ষিণ) কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরীর (ডালু) পোস্টারে দেখা যাচ্ছে এক দল ঝকঝকে তরুণ-তরুণীকে। কারণ, দাদা গনি খানের নামাঙ্কিত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে তাস করে নিজেকে ভবিষ্যতের কারিগর হিসেবে পেশ করছেন ডালু। মোবাইল ভ্যানে ডালুবাবুর ভ্রাম্যমাণ প্রচার-মঞ্চে আইপিএল ম্যাচও দেখানো হতে পারে। গত বার উলুবেড়িয়ার বিজেপি-প্রার্থী রাহুল চক্রবর্তীর প্রচারে নিয়মিত যাত্রার আসর বসত। সেখানে প্রার্থী উপস্থিত থাকতেন। সরাসরি ভোটের কথা না-বলেও প্রচার হয়েই যেত। কিন্তু এ সব কৌশল ভোটবাক্সে ছাপ ফেলে কি? উপদেষ্টাদের দাবি, ফেলে। জেতার আশা না-থাকলেও প্রচারের কৌশলেই গত লোকসভা ভোটে এ রাজ্যের কয়েকজন বিজেপি প্রার্থী ৭০-৮০ হাজার ভোট টেনেছিলেন বলে তাঁদের দাবি।
রায়গঞ্জের সমাজবাদী প্রার্থী সুদীপরঞ্জন সেন বা ডায়মন্ড হারবারের পিডিএস প্রার্থী সমীর পুততুণ্ডও এ বার অ্যাড এজেন্সি-র শরণ নিয়েছেন। বলছেন, “ঘুরে-ঘুরে প্রচার করার সময় পোস্টারের খুঁটিনাটি নিজে দেখার সময় মেলে না। ফেসবুকেই বা কত ক্ষণ তাকিয়ে থাকব? এর থেকে এই ভাল!”
আর বড় দলের বড় নেতা-নেত্রী? তাঁরাও কি পেশাদার সাহায্য নিচ্ছেন? শাসক দলের কোনও কোনও প্রার্থী বা বাম দলগুলোর কয়েক জন শুভানুধ্যায়ী পেশাদার সাহায্যপুষ্ট প্রচারে বিশ্বাসী। তবে তাঁরা সেটা মুখে স্বীকার করতে নারাজ। তৃণমূলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলছেন, “পয়সা দিয়ে প্রচার সম্ভব নয়। সৃজনশীল বন্ধুরা ভালবেসে সাহায্য করলে স্বাগত!” বারাসতে তৃণমূলের কাকলি ঘোষদস্তিদার জানান, তাঁর ওয়েবসাইটটি পেশাদার বন্ধুদের তৈরি করে দিতে বলেছেন। বাকিটা নিজেরা সামলাচ্ছেন।
গত লোকসভা ভোটে সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের প্রচারে ‘জয় হে’ লেখা ফ্লেক্স চোখ টেনেছিল। এ বারও তাঁর ‘রায়গঞ্জের রায়’ পোস্টার ও ফেসবুক পেজ ‘রায়গঞ্জে সেলিম’ নিয়ে জল্পনা চলছে। সেলিম বলছেন, “পার্টির তরুণ সমর্থকরাই এ সব করেছেন। আমাদের অত পয়সা নেই, একটু মাথা খাটালে পেশাদার সাহায্য লাগেও না।”