প্রচার শেষ তো কী, ফাইনালের আগে বিশ্রাম নেই

ক্রিকেটে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচে ‘রেস্ট ডে’র চল এখন কার্যত অতীত। কঠিন ভোটযুদ্ধে প্রচারের পাট চুকলেও বিশ্রামের নামগন্ধ বড় একটা চোখে পড়ল না। রাজ্য তথা দেশে লোকসভা ভোটের শেষ দফার আগের দিন, নেতাদের মিটিং-মিছিল-ভাষণ ছিল না বলাই বাহুল্য! তা বলে ভোটের উত্তাপ থেকে রেহাই মিলল কই?

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০৩:৪৬
Share:

সুভাষিণী আলি, শুভেন্দু অধিকারী, সোমেন মিত্র ও বাবুল সুপ্রিয়

ক্রিকেটে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচে ‘রেস্ট ডে’র চল এখন কার্যত অতীত। কঠিন ভোটযুদ্ধে প্রচারের পাট চুকলেও বিশ্রামের নামগন্ধ বড় একটা চোখে পড়ল না।

Advertisement

রাজ্য তথা দেশে লোকসভা ভোটের শেষ দফার আগের দিন, নেতাদের মিটিং-মিছিল-ভাষণ ছিল না বলাই বাহুল্য! তা বলে ভোটের উত্তাপ থেকে রেহাই মিলল কই? রবিবার বিকেলে ব্যারাকপুরের সিপিএম প্রার্থী সুভাষিণী আলিকে ফোনে ধরতেই

তাঁর ‘পায়ের তলায় সর্ষে’ মেজাজটি টের পাওয়া গেল! “কীসের বিশ্রাম! নানা জায়গায় পার্টি অফিস ভাঙচুর, কর্মীদের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়া চলছে। আমি এখন আমডাঙা যাচ্ছি! তারপরই বীজপুর যেতে হবে!” প্রবীণ প্রার্থীর স্বরে ব্যস্ততার ছোঁয়াচ। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি তথা কলকাতা (উত্তর) কেন্দ্রে প্রার্থী রাহুল সিংহও ফোন ধরেই অন্য একটি ফোনে কর্মীদের বিস্তর নির্দেশ দিতে ব্যস্ত। বিকেল তিনটেয় চড়া রোদ মাথায় বেরিয়ে রাহুলবাবু নির্বাচন কমিশনের কাছে দরবার করতে যাচ্ছেন। বললেন, “ভোটের আগেই যা সন্ত্রাস শুরু হয়েছে, তাতে এখন ঘরে বসে থাকার জো নেই!’’

Advertisement

টানা দেড় মাস কেন্দ্রে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, কাকভোরে উঠে প্রচার, পারিবারিক জীবন ওলটপালট হওয়া এ সবই এ গণতন্ত্রে ভোটপ্রার্থীর রোজনামচার অঙ্গ। ভোটের ৩৬ ঘণ্টা আগে প্রচারের সময়সীমা পার হলে এই শ্রম থেকে সামান্য ফুরসত মেলে। এ বার চতুর্মুখী লড়াইয়ে যুদ্ধং দেহি আবহ অনেক প্রার্থীর বিশ্রামেই জল ঢেলে দিয়েছে। বহরমপুরে শক্তিপুরের পথে কংগ্রেসের ‘গড়ে’ শাসক দল অধীররঞ্জন চৌধুরীর গাড়ি আটকেছে বলে খবর চাউর হয় এ দিন দুপুরে। বিকেল হতেই সালারে তৃণমূলের ইন্দ্রনীল সেনের উপরে হামলার খবরও মিলল।

দিনের শুরুটা কিন্তু অন্য রকম ছিল। শনিবার দিনভর কপ্টার-সফরের ক্লান্তি সত্ত্বেও বিজেপির প্রচারের মুখ বাবুল সুপ্রিয় সকালটা বিবেকানন্দ পার্কে ফুটবল পেটানোর লোভ সামলাতে পারেননি। সুব্রত ভট্টাচার্য প্রমুখের সঙ্গে ঘণ্টা দেড়েক ফুটবল খেলেছেন অধুনা কার্যত হোলটাইমার রাজনীতিক বনে যাওয়া বলিউডি গায়ক। তারপরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেলাবেলি কলকাতার হোটেলে মধ্যাহ্নভোজের আগেই চারধারে রাজনৈতিক ঝুটঝামেলার ফোন আসতে শুরু করেছে। সন্ধেয় নিজের পুজোর গান-সংক্রান্ত একটা মিটিং আগে ফেলা ছিল। এর মধ্যে এ সব খবরে বাবুলের মন-মেজাজ বিস্বাদ ঠেকছে।

কলকাতা দক্ষিণ কেন্দ্রে সিপিএমের নন্দিনী মুখোপাধ্যায় বা কলকাতা উত্তর-এর সোমেন মিত্রও বেশ বিচলিত। অনেক দিন বাদে রবিবার সকালটা ঘর-গেরস্থালির কিছু কাজের জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন নন্দিনী। কিন্তু বিকেলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র-নিগ্রহের খবর পেয়ে অধ্যাপক-প্রার্থীকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছে। বেলঘরিয়ায় দলের আহত কমরেডকেও দেখতে গিয়েছিলেন। সোমেন মিত্রের মতে, “শেষ দিনটা দলীয় কর্মীদের সঙ্গে বুথে বসাবসি নিয়ে মিটিং করতেই হয়! কিন্তু এখন সন্ত্রাস নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছি!” হামলার খবর পেয়ে কলকাতা উত্তর-এর সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচি সারা দিনে কখনও কাশীপুর, কখনও শ্যামপুকুর ছুটে বেড়াচ্ছেন। এক ফোঁটা বিশ্রামের জো নেই।

প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঘাড় সোজা করে লড়তে গিয়ে যাদবপুরের বাম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর এ দিনও

দুপুরে বাড়ির ভাত খাওয়া পণ্ড। বারুইপুরের দলীয় অফিসে বসে মুড়ি-বাদাম খেয়েই বিভিন্ন বুথে কমরেডদের চাঙ্গা করছেন।

সন্ত্রাসের আশঙ্কায় এই মাথাব্যথা বিরোধীদের একচেটিয়া বললে ভুল হবে। বারাসতের তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদার মধ্যমগ্রামের ভোটকালীন ঘাঁটি থেকে কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাজারহাটের নারায়ণপুরে কিছু ওয়ার্ড বা মহিষবাথানে বিরোধীদের দাপট ঠেকাতে বাড়তি নিরাপত্তাকর্মী চাইছেন তিনি।

শাসক দলের ডাকসাইটে প্রার্থীরাও মানসিক ভাবে ‘ইলেকশন মোড’ থেকে বেরোতে পারছেন কই?

ঘাটালে দেব যেমন এই ছুটির দিনেও দলীয় কর্মীদের জনে-জনে ফোন করে এত দিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন। দেবের ফোন পেয়ে অভিভূত পিংলার নেতা অজিত মাইতি বলছেন, “ও খুব সুন্দর করে আমায় শরীরের যত্ন নিতে বলল। ভারী মিষ্টি ব্যবহার!” নিজের কেন্দ্র থেকে শনিবার রাতেই কলকাতা রওনা হয়েছিলেন দেব। আজ সোমবার ভোট উপলক্ষে সকাল-সকাল তাঁর ঘাটাল ফেরার কথা।

“পরীক্ষার আগে আপনি শান্তিতে থাকতে পারবেন! গলা দিয়ে খাবার নামবে?” প্রশ্নকর্তা কৃষ্ণনগরের তৃণমূল প্রার্থী চিত্রতারকা তাপস পাল। তাপস এ দিন সকালে কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় এসেছেন, পরের দিন নিজের ভোটটা দেবেন বলে। মেনুতে অনেক দিন বাদে স্ত্রী-র রান্না পাতলা মাছের ঝোল। কিন্তু মনটা শান্ত হচ্ছে কই? কলকাতায় বসেও তাপস মনে-মনে এবং ফোনে-ফোনে কৃষ্ণনগরেই রয়েছেন। যাদবপুরে তৃণমূলের সুগত বসুর ভোট-সেনাপতি অরূপ বিশ্বাসও দুপুরটা রানিকুঠির দলীয় অফিসে বন্দি। দলীয় কর্মীদের সব কিছু বোঝানোর পরও শেষ বার ঝালিয়ে নেওয়া চলছে।

তবু গোটা একটা দিন প্রচারের ঝক্কি থেকে নিষ্কৃতি মিললে কিছু ব্যক্তিগত কাজ তো সারা যায়! কলকাতা দক্ষিণ-এর তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সী ও তাঁর এজেন্ট দলের প্রবীণ নেতা সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়

তাই দুপুর-দুপুর ভবানীপুরে প্রিয়নাথ মল্লিক লেনের অফিস থেকে বেরোলেন। সচ্চিদানন্দবাবু অনেক দিন পরে একটি পারিবারিক নিমন্ত্রণরক্ষার সুযোগ পেয়েছেন।

প্রচারের শেষে তমলুকের প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীও রাজনৈতিক কাজের বদলে সামাজিকতার মধ্যে দিনটা কাটালেন। সকালে মহিষাদলে দলীয় কর্মীর বাড়িতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাজিরায় ফাঁকি দেননি। রাতে হলদিয়ায় বিয়েবাড়িতে পেট পুরে খেলেন। তা বলে রাজনীতি থেকে ‘ছুটি’তে ছিলেন বললে মানবেন না শুভেন্দু। বলছেন, “ভোটের আগে কত কাজ! আর এই মোবাইলের যুগে ‘রেস্ট ডে’ বলে কিছু হয় না কী!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন