আক্রমণের মুখে কোমর বাঁধছে বিজেপি

পাড়ুইয়ের স্মৃতি উস্কে অনুব্রতের ঘনিষ্ঠ অধরাই

আবার অভিযোগের তির বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীদের দিকে। আবার সেই পাড়ুই-কাণ্ডের ছায়া! বিজেপি সমর্থক শেখ রহিম খুনের ঘটনায় ইলামবাজার ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা বীরভূম জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ কর্মাধ্যক্ষ জাফারুল ইসলাম-সহ ৩৬ জন স্থানীয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তুলেছে নিহতের পরিবার।

Advertisement

মহেন্দ্র জেনা

ইলামবাজার শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৪ ০৩:৪৬
Share:

অভিযুক্ত জাফারুল ইসলাম।

আবার অভিযোগের তির বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীদের দিকে। আবার সেই পাড়ুই-কাণ্ডের ছায়া!

Advertisement

বিজেপি সমর্থক শেখ রহিম খুনের ঘটনায় ইলামবাজার ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা বীরভূম জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ কর্মাধ্যক্ষ জাফারুল ইসলাম-সহ ৩৬ জন স্থানীয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তুলেছে নিহতের পরিবার। শনিবার রাতে নিহতের ভাই শেখ নাফিজুল ইলামবাজার থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। জাফারুল তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রতবাবুর ঘনিষ্ঠ হিসাবেই পরিচিত। ঘটনাচক্রে, যিনি নিজেও পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত।

নিহতের পরিবারের আরও অভিযোগ, ঘটনার সময় গ্রামে ইলামবাজার থানার এএসআই স্বরূপ পাণ্ডা-সহ অন্যান্য পুলিশকর্মী উপস্থিত থাকলেও তাঁরা কোনও পদক্ষেপ করেননি। স্বরূপবাবু এ দিন বলেছেন, “এ ব্যাপারে যা বলার পুলিশ সুপারই বলবেন।” বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “কানুর গ্রামের ঘটনায় আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজ চলছে।” তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, পুলিশি গাফিলতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। বোলপুর আদালত এ দিন ধৃতদের চার দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

Advertisement

ইলামবাজারের থানার ঘুড়িষা পঞ্চায়েতের কানুর গ্রামের বিজেপি সমর্থক শেখ রহিমকে শনিবার দুপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। বিজেপি-র অভিযোগ, জাফারুলের নির্দেশে স্থানীয় তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য, নেতা-কর্মী এবং তাঁদের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। জাফারুলের অবশ্য দাবি, “এই ঘটনা দুঃখজনক। তবে শেখ রহিম এক জন সাধারণ খেতমজুর। তাঁকে আমরা খুন করতে যাব কেন? বিজেপি রাজনৈতিক জমি পেতে ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাদের জড়িয়ে দিচ্ছে।” তবে ঘুরিষারই বাসিন্দা, জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি, সিপিএমের অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায় বলেন, “জাফারুলের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানো অসম্ভব! বিধানসভা, পঞ্চায়েত, লোকসভাসব ভোটেই তৃণমূল এই এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আমিও তার ভুক্তভোগী!”

পঞ্চায়েত ভোটের সময় বীরভূমে তৃণমূলের নিশানায় ছিলেন নির্দল প্রার্থী ও সমর্থকেরা। যাঁরা শাসক দলেরই বিক্ষুব্ধ অংশ। এখন বিজেপি-র উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাম, কংগ্রেস, এমনকী তৃণমূল ছেড়েও যখন গেরুয়া শিবিরে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে, তখন আক্রমণের নিশানাও বদলে গিয়েছে। এমনই অভিযোগ বিজেপি-র এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের।

গত পঞ্চায়েত ভোটে একটি জেলা পরিষদের আসন ছাড়া গোটা ইলামবাজার ব্লকে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল। জাফারুলের নেতৃত্বেই তৃণমূল কর্মীরা অন্য কোনও আসনে কাউকে মনোনয়নপত্র জমা করতে দেননি বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কিন্তু সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের ফলে দেখা যায়, বিজেপি ওই ব্লকে ২০%-এরও বেশি ভোট পেয়েছে। ভোট মিটতেই তৃণমূলের ‘অত্যাচারে’ অতিষ্ঠ এলাকার বহু সিপিএমের কর্মী-সমর্থক নিরাপত্তা পেতে বিজেপি-তে যোগ দিতে শুরু করেন। সম্প্রতি তৃণমূলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ওই কর্মী-সমর্থকেরা ইলামবাজার থানায় স্মারকলিপিও দেন। নিহতের

সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ওই কর্মী-সমর্থকেরা ইলামবাজার থানায় স্মারকলিপিও দেন। নিহতের পরিবারের দাবি, তাঁরাও ওই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই আক্রোশেই শনিবার রীতিমতো ছক কষে গ্রামে হামলা চালিয়ে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা রহিম শেখকে খুন করে।

যদিও জাফারুলের দাবি, কানুর গ্রামের সাড়ে ন’শো ভোটারের মধ্যে লোকসভা ভোটে বিজেপি মাত্র ১২টি ভোট পেয়েছে। ওই গ্রামে বিজেপি-র কোনও সংগঠনই নেই। তাঁর বক্তব্য, “আক্রমণ করতে হলে আমরা সিপিএমকে আক্রমণ করতাম! বিজেপি-র সংগঠন বাড়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তা নেহাতই গুজব! ওই খুনটি আদতে গ্রাম্য বিবাদেরই জের।” তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বও গ্রাম্য বিবাদের তত্ত্বই দিয়েছেন।

ঘটনার পরে পুলিশ সুপারের নির্দেশে শনিবার রাত থেকে গ্রামে পুলিশ পিকেট ছিল। রবিবার দুপুরে নিহতের দেহ এলে গোটা গ্রাম ফেটে পড়ে। ইলামবাজার থানায় পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করে দুপুর দু’টো নাগাদ নিহত সমর্থককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শমীক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বিজেপি-র পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গ্রামে পৌঁছয়। প্রতিনিধিদলে প্রাক্তন ডিজি আর কে মোহান্তি, প্রাক্তন আইজি শঙ্কর মুখোপাধ্যায়, শুভ নারায়ণ সিংহ, রামকৃষ্ণ পালও ছিলেন। প্রাক্তন পুলিশ-কর্তাদের দিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বিজেপি। গ্রামের আক্রান্ত পরিবারগুলির মেয়েরা শমীকবাবুকে জানান, ঘটনার সময় নিজেদের সম্ভ্রম বাঁচাতে তাঁরা কয়েক ঘণ্টা ধরে পুকুরে লুকিয়ে ছিলেন।

পরে শমীকবাবু বলেন, কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের সামনেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে নিহতের পরিবার তাঁদের জানিয়েছে। তাঁর বক্তব্য, “স্রেফ অন্য দলকে সমর্থনের অপরাধে এক জন প্রান্তিক মানুষকে মেরে ফেলা হল! তাঁদের পরিবারের মা-বোনেদের সম্ভ্রমহানির চেষ্টা হল। এটা বরদাস্ত করব না।” রাজ্যের সংখ্যালঘু কমিশন বা মানবাধিকার কমিশন কী করছে, প্রশ্ন তুলেছেন শমীক। পাশাপাশি, এ দিনই কলকাতায় রাজ্য বিজেপি-র দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ জানিয়েছেন, তাঁদের দলের সংখ্যালঘু মোর্চার কেন্দ্রীয় দল ইলামবাজার ঘুরে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের কাছে অভিযোগ জানাবে। সিদ্ধার্থনাথের মন্তব্য, “উত্তরপ্রদেশের মতোই এ রাজ্যেও গুন্ডারাজ চলছে! মানুষের উপরে অত্যাচার করলে যে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না, কংগ্রেসকে দেখেও উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি তা শেখেনি। এখানেও তৃণমূল কোনও শিক্ষা নেয়নি!”

রাজ্যের অন্যত্রও বিজেপি কর্মীদের উপরে আক্রমণ অব্যাহত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর ফুলমালঞ্চ গ্রামে বিজেপি কর্মী-সমর্থক উপরে হামলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। জখম তিন বিজেপি কর্মীকে বাসন্তী ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, শনিবার রাতে বিজেপি কর্মীদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন হয়েছিল ওই গ্রামে। অভিযোগ, বৈঠক সেরে ফেরার পথে তৃণমূলের লোকজন বিজেপি কর্মীদের বাঁশ-লাঠি দিয়ে পেটায় বলে অভিযোগ। তবে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন গোসাবার তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন