সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ।
বীরভূমের পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিস্তর গাফিলতির জন্য আঙুল উঠল তদন্তকারী পুলিশের দিকে। আঙুল তুললেন খোদ পুলিশ সুপারই!
রাজ্য পুলিশের ডিজি’র নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল (স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম, সংক্ষেপে সিট)-এর কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে বীরভূমের এসপি রশিদ মুনির খান সম্প্রতি বলেছেন, পাড়ুই থানার তদানীন্তন ওসি এবং তদন্তকারী অফিসার (আইও) খুনের তথ্য-প্রমাণ লোপাট করে দিয়েছেন। সেই ওসি সম্পদ মুখোপাধ্যায় এবং আইও দ্বিজরাজ সাহানার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরুরও অনুমতি চেয়েছেন তিনি। রাজ্য পুলিশের আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা মঙ্গলবার বলেন, “রিপোর্ট এসেছে। ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।” নবান্ন-সূত্রের খবর, নির্বাচন চলাকালীন এ নিয়ে পদক্ষেপ করা হবে না। তবে ভোটপর্ব মিটে গেলেই এসপি’কে বলা হবে দুই অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
২০১৩-র ২১ জুলাই, চতুর্থ দফার পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগের রাতে পাড়ুইয়ের কসবা গ্রামের বাঁধ নবগ্রামে গুলিতে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগরবাবু, যাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রবধূ শিবানীদেবীর অভিযোগ ছিল, শ্বশুরমশাইকে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে পুলিশ জবরদস্তি তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে, এবং তাতে ক’জনের নাম লিখে সেই সব লোককে গ্রেফতার করে আসল অপরাধীদের আড়াল করেছে। তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ এনে হৃদয়বাবু সিবিআই-তদন্তের আর্জি জানান কলকাতা হাইকোর্টে। হাইকোর্টের নির্দেশেই পুলিশ সাগর-হত্যার এফআইআর নেয়, যাতে অনুব্রত মণ্ডলের পাশাপাশি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীরও নাম আছে। এফআইআরে উল্লিখিত তৃতীয় ব্যক্তি গ্রেফতার হলেও অনুব্রত-বিকাশ এখনও অধরা। কোর্টের কাছে সাগরবাবুর পরিজনদের দেওয়া জবানবন্দিতেও অভিযুক্ত-তালিকায় অনুব্রতের নাম রয়েছে এক নম্বরে।
এমতাবস্থায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পাড়ুই-তদন্তে বিশেষ দল (সিট) গড়ে দিয়ে হাইকোর্ট রাজ্য পুলিশের ডিজি’কে মূল তদন্তকারী নিযুক্ত করে। তবে সিটের তদন্তের রকম-সকম দেখে হাইকোর্ট বার বার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এবং মূলত হাইকোর্টের ভর্ৎসনাতেই সিট এখন নড়েচড়ে বসেছে বলে নবান্ন-সূত্রের ইঙ্গিত। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, “পাড়ুই-কাণ্ডে যে সব পুলিশ অফিসার যথাযথ তদন্ত করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিজি জিএমপি রেড্ডি এপ্রিলের মাঝামাঝি বীরভূমের এসপি’কে চিঠি দিয়েছিলেন। এসপি জেলাস্তরে তদন্ত করে দুই অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরুর অনুমতি চেয়েছেন।” নবান্নের খবর, ডিজি’র নির্দেশের প্রেক্ষাপটে বীরভূমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়ের কাছে তদন্তের যথাযোগ্যতা সম্পর্কে রিপোর্ট চেয়েছিলেন পুলিশ সুপার। এএসপি তাঁর রিপোর্টে পরিষ্কার লেখেন, ‘পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্ত ঠিকঠাক হয়নি। ওসি সম্পদ মুখোপাধ্যায় ও তদন্তকারী অফিসার দ্বিজরাজ সাহানা তদন্ত-প্রক্রিয়াটাই ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। তথ্য-প্রমাণ লোপাটেরও চেষ্টা করেছেন তাঁরা।’’
সম্পদ-দ্বিজরাজকে আপাতত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের পলিগ্রাফ পরীক্ষা করানোর জন্য সিট কিছু দিন আগে সিউড়ি কোর্টের অনুমতি চেয়েছিল। আদালত অনুমতি দিয়েও দেয়। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার যুক্তিতে দুই অফিসার পলিগ্রাফ টেস্টে রাজি হননি। পাড়ুই-তদন্তে ওঁদের তরফে কী কী গাফিলতি ধরা পড়েছে জেলা পুলিশ-কর্তাদের চোখে?
নবান্নের খবর: এএসপি’র রিপোর্টে একাধিক গাফিলতির উল্লেখ রয়েছে। যেমন, খুনের রাতে ওসি কী উদ্দেশ্যে বাঁধ নবগ্রামে গিয়েছিলেন, থানার জেনারেল ডায়েরি (জিডি) খাতায় তার উল্লেখ নেই। ওসি কখন ফিরলেন, প্রাথমিক তদন্তে কী মিলল, সে সবও লিপিবদ্ধ হয়নি। উপরন্তু জিডি-খাতায় খুনের বিবরণ লিখতে গিয়ে অজস্র কাটাকুটি হয়েছে। যা থেকে মনে হয়, ওসি এবং আইও বারংবার বিবরণ বদলেছেন।
অভিযুক্তদের সুবিধা করে দিতেই এ সব করা হয়েছে বলে রিপোর্টে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্টের দাবি: দুই অফিসার ঘটনাস্থলে গিয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টাই করেননি। খালি কার্তুজ, রক্তের নমুনা, দেওয়ালে রক্তের দাগ-সহ নানা তথ্য-প্রমাণ নিয়ম মেনে সংগ্রহের পরিবর্তে ওঁরা সাগরবাবুর বাড়ির দাওয়ায় রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলায় ব্যস্ত ছিলেন। সাগরবাবুর রক্তমাখা লুঙ্গিটিও ধুয়ে ফেলতে বলেছিলেন। ওসি গুলিবিদ্ধ সাগরবাবুকে হাসপাতালে না-পাঠিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন, যাতে সময় নষ্ট হয়। প্রচুর রক্তপাতে সাগরবাবু নেতিয়ে পড়েন। রিপোর্টের বক্তব্য, আরও আগে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো ওঁকে বাঁচানো যেত।
দোষীদের আড়াল করার চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে রিপোর্টে। বলা হয়েছে, ওসি-আইও অভিযুক্তদের বদলে সাগরবাবুর আত্মীয়দেরই গ্রেফতার করেন, যার পিছনে তদন্তের অভিমুখ ঘোরানোর উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সাগরবাবুর পরিবারের দায়ের করা অভিযোগে যে ৪১ জনের নাম ছিল, তাদের অনেককেই ওঁরা ধরতে পারেননি। অভিযোগকারীকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে তাতে নিজেদের মতো করে লিখেছিলেন এফআইআরের বয়ান। রিপোর্টের মতে, একই মামলায় একাধিক জিডি, এফআইআর এবং আলাদা আলাদা বয়ান লিখে দুই অফিসার আদতে তদন্ত-প্রক্রিয়াই বিলম্বিত করেছেন।
এএসপি’র রিপোর্টের ভিত্তিতে এ বার ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছেন এসপি। “পাড়ুই-মামলা খতিয়ে দেখে মনে হয়েছে, ওই দুই অফিসারের গাফিলতি ছিল। ওঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তাই ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।” এ দিন বলেন রশিদ মুনির। সম্ভাব্য শাস্তির মুখে পড়তে চলা দুই পুলিশ অফিসারের কী প্রতিক্রিয়া?
সম্পদবাবু আপাতত সিউড়ির ডিআইবি’তে কর্মরত। এ দিন তিনি ফোনে বলেন, “আমি তো ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছুই জানি না! কাজেই কিছুই বলার নেই।” দ্বিজরাজবাবুর মন্তব্য, “ভোটের ডিউটিতে রয়েছি। তাই জানি না, ঠিক কী হয়েছে।’’