গোলাপি মলাটের বইখানা যে লিখেছে, তাকে হাতের নাগালে পেলে দু’কথা শুনিয়ে দিত দুবরাজপুরের রঞ্জনবাজারের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ভূমিকা দাস, লাভপুরের ষষ্ঠীনগরের পঞ্চম শ্রেণির ঋতম চট্টোপাধ্যায়রা। পুজোর বরাদ্দে একটা গোটা দিন কমিয়ে দিয়েছে ওই বইটা। বড়রা মাস খানেক আগেই ওই পঞ্জিকা দেখে জানিয়ে দিয়েছেন এ বার দুর্গা পুজো তিনদিনের। তারপর থেকেই মন খারাপ কচিকাঁচাদের। “তিনদিন কেটে চারদিন করা যায় না?” ঘনঘন প্রশ্ন করছে তারা।
বড়দেরও ধন্দ যেতে চায় না। এ বার কি পঞ্চমীতেই বোধন? মহাষ্টমীর অঞ্জলি কি দেওয়া যাবে না? মহানবমীর হোমই বা ওইটুকু সময়ে কি করে হবে? নবমী-দশমী একই দিনে হওয়ায় কবে, কখন প্রতিমা বিসর্জন হবে? এমনই সব প্রশ্ন ঘিরে নবীন-প্রবীণ পুরোহিতদের বিতর্ক যেন শেষই হচ্ছে না। নবদ্বীপ বঙ্গ বিবুধ জননী সভার তত্ত্বাবধানে পৌরহিত্য কর্মশালায় আসন্ন দুর্গাপুজো উপলক্ষে চলছে সাপ্তাহিক কর্মশালা। সেখানেও আলোচনার কেন্দ্রে ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’। ইতিপূর্বে একই দিনে দুর্গাপুজোর অষ্টমী-নবমী বা সপ্তমী-অষ্টমী পড়েনি এমন নয়। কিন্তু এবারের মতো ষষ্ঠী, অষ্টমী, সন্ধিপুজো, নবমী, দশমী -- প্রায় প্রতিদিনের পুজোর জন্য পঞ্জিকাতে এত স্বল্পসময় শেষ কবে ছিল তা কেউই মনে করতে পারছেন না। ফলে সকলেই সময় সংকটে পড়েছেন।
নবদ্বীপের বিশিষ্ট শাস্ত্রকার শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “অধিকাংশ বছর দুর্গা পুজো চার দিনের হয়। এ বারে সকাল ৮টা ১৪ মিনিটে অষ্টমী শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওই দিনই নবমী পুজোও সম্পূর্ণ হচ্ছে। এ বারে পুজো তাই তিনদিনের। এর আগেও এমনটা হয়েছে।”
ঠিক কী হচ্ছে এ বার? অধিকাংশ পঞ্জিকাতে মহাপুজোর প্রধান তিনটি দিন, অষ্টমী, নবমী এবং দশমীর যাবতীয় কৃত্য দুদিনেই শেষ। শুধু তাই নয়, দু’দিনেই যাবতীয় ক্রিয়াকর্মের সাত-সকালেই ইতি। আর ঠিক এখানেই বেধেছে গোল। বঙ্গ বিবুধ জননী সভার সহ-সম্পাদক শুভেন্দু কুমার সিধান্ত বলেন, হিন্দুদের যাবতীয় কৃত্য সূর্যোদয় অনুসারে হয়ে থাকে। সেই মতো তিথির সময় কখনও খুব স্বল্প, কখনও আবার দীর্ঘ হয়। তবে এবারে দুর্গাপুজোর সবদিনই তিথিগুলি স্বল্পকালীন। তাতেই সময় নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে।
সময় সংকটের একটা নমুনা এই রকম। মহাষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন বেশির ভাগ বাঙালি। অথচ এবার অষ্টমী শেষ হয়ে যাচ্ছে সকাল ৮.২৯ মিনিটে। এরও ২৪ মিনিট আগে থেকে শুরু করতে হবে সন্ধিপুজো। কারণ অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট, এবং নবমীর প্রথম ২৪ মিনিট, এই মোট ৪৮ মিনিট হল সন্ধিপুজোর সময়। সেই মতো পুরোহিত মশাইকে সকাল ৮.০৫ মিনিটে সন্ধিপুজো শুরু করতে হবে। ৮.৫৩ মিনিটে সন্ধিপুজো শেষ হয়ে নবমী পড়ে যাবে। তা হলে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া জন্য কতটুকুই বা সময় থাকবে? পুরুষানুক্রমে পৌরহিত্য করছেন সুশান্ত ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “মহাষ্টমীর মতো পুজো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে শেষ করাই অসম্ভব।”
কেন? সুশান্তবাবু বলেন, ওই দিন সূর্যোদয় সকাল ৫.৩১ মিনিটে। তারও একদণ্ড অর্থাৎ ২৪ মিনিট আগে পুজো শুরু করা যেতে পারে। তাতেও সকাল ৮.০৫ এর মধ্যে মহাষ্টমীর মহাস্নান, ভোগ বা যেখানে বলি হয় সব মিলিয়ে দুর্গাপুজোর যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা কঠিন। সন্ধিপুজো আবার ঠিক ৮.২৯ মিনিটেই শুরু করতে হবে। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য কি করে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার সময় বের করবেন পুরোহিত মশাই?
এখানেই শেষ নয়। সমস্যা আছে নবমীর হোম এবং দশমী নিয়েও। নদিয়ার রাজ পুরোহিত অসীম ভট্টাচার্য বলেন, সন্ধিপুজো সমাপ্ত মানেই নবমী পড়ে গেল। অর্থাৎ যেদিন মহাষ্টমী সেই দিন সন্ধিপুজো শেষ করেই নবমীর পুজো করতে হবে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরীর পুজো এভাবেই হবে। পরদিন, অর্থাৎ ৩ অক্টোবর সূর্যোদয়ের পর খুব সামান্য সময় নবমী থাকবে। তারপরই দশমী শুরু হয়ে যাচ্ছে। নদিয়া রাজবাড়ির চিরাচরিত প্রথা দশমীর দিন সূর্যাস্তের সময় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া। সেই প্রথা মেনে ৩ অক্টোবর শুক্রবারই বিসর্জন হবে।
ভাগবত পাঠক এবং নবদ্বীপের আর এক শাস্ত্রজ্ঞ গোরাচাঁদ ভট্টাচার্য বলেন, সময়ের স্বল্পতার জন্য এ বার মহানবমীর হোম দু’দিনে করাই বিধেয়। হোমে সাধারণত ১০৮টি বেলপাতা দিয়ে আহুতি দেওয়া হয়। এবারে তার মধ্যে একশটি বেলপাতা দিয়ে প্রথম দিনে, এবং বাকিটা আটটা পাতা দিয়ে দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ শুক্রবার হোম করা হবে। হোমের আগুন সংরক্ষণ করা হবে।
অন্য দিকে সতী দেবভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান পণ্ডিত বেনু মুখোপাধ্যায় জানান, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে সামান্য কিছু বেশি সময় পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা দুর্গাপুজোর জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়/ তাই এবারে সমস্ত কিছুই সংক্ষিপ্ত ভাবে সারতে হবে। সূর্যোদয়ের ২৪ মিনিট আগে থেকে পুজোর কাজ শুরু করে ফেলতে হবে। মহাস্নান, হোম, বলি, আরতি, অঞ্জলি কোনও রকমে নির্দিষ্ট সময়ে ছুঁয়ে যাওয়া মাত্র। এমন কি এবার তিনবার করে নয় মাত্র একবার অঞ্জলি দিতে হবে। সময়ের স্বল্পতায় এছাড়া পথ নেই। পুরোহিতরা না হয় পুজো কাটছাঁট মেনে নিলেন, ব্যবসার লাভে কাটছাঁট মেনে নেওয়া কি সহজ? নানুরের বারিয়া মোল্লা, আমোদপুরের রতন দাসরা বলেন, “আমরা বাজি-পটকা বিক্রি করি। পুজোর একটা দিন কমে যাওয়ায় বিক্রিও মার খাবে।” একই আশঙ্কা ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়ার খাবারের দোকানদার সঞ্জিত কোনাই, কোটাসুরের মহাদেব দাসদেরও। তাঁদের আক্ষেপ, “পুজোর দিন প্রিয়জনদের নিয়ে ঠাকুর দেখার ফাঁকে মানুষজন খাবারের দোকানেও ভিড় জমান। ওই সময় অধিকাংশই থাকেন দরাজহস্ত। ভাল বিক্রিও হয়। এ বার ব্যবসা একদিন কমে যাবে।”
পুজো কমিটিগুলি অবশ্য ওই ঘাটতি পুরণে নানা রকম পরিকল্পনা নিয়েছে। দুবরাজপুর ইয়ুথ কর্ণার ক্লাবের সম্পাদক সোমেশ আচার্য, লাভপুর ষষ্ঠীনগর ইয়ং সোসাইটির সন্দীপ ঘোষরা বলেন, “পুজোর এক দিনের অভাব পূরণ করতে আমরা পঞ্চমী থেকেই মণ্ডপ খুলে নানা অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”