দৃষ্টান্ত হলদিয়া।
জাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য নিলামের মাধ্যমে খালাসকারী সংস্থা বাছাইয়ের যে রাস্তা ওই বন্দর দেখিয়েছে, এ বার তাকেই মডেল করছে জাহাজ মন্ত্রক। ১২ অগস্ট দেশের ১২টি বন্দরের চেয়ারম্যানকে মন্ত্রকের নির্দেশ, ২০১৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে নিলাম মারফত পণ্য খালাসকারী সংস্থা বাছাই সেরে ফেলতে হবে তাদের।
শুধু তা-ই নয়। মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারি এ আর সেনগুপ্ত বন্দর চেয়ারম্যানদের বলেছেন, এ বিষয়ে তাঁরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তা জানিয়ে দিতে হবে চলতি মাসের মধ্যেই।
কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ বলেন, ‘‘হলদিয়ার নীতি যে সারা দেশের জন্য গ্রহণ করা হচ্ছে, এটা আনন্দের। স্বচ্ছতার সঙ্গে বন্দর-প্রশাসন চালাতে হলদিয়াই এখন মডেল।’’
বন্দরে পণ্য খালাসের অব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ বহু দিনের। এত দিন বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে নামমাত্র টাকার বিনিময়ে ওই পরিষেবা দেওয়ার লাইসেন্স আদায় করত বিভিন্ন সংস্থা। এবং তার পরে ইচ্ছেমতো ফি (দর) ঠিক করত পণ্য খালাসের জন্য। ফলে এক দিকে, ওই সমস্ত সংস্থা বহু টাকার ব্যবসা করলেও সরকারের ঘরে প্রায় কিছুই আসত না। আবার অন্য দিকে, বেড়ে যেত পণ্য খালাসের খরচ। যার প্রভাব পড়ত জিনিসপত্রের দামেও।
সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেত, যে সংস্থা যে বন্দরে বরাত পাচ্ছে, সেই অঞ্চলে তাদের প্রভাব এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ বেশ পোক্ত। ফলে সরকারের ক্ষতি হলেও, একবার লাইসেন্স হাতিয়ে ফেলার পরে স্বচ্ছন্দে ব্যবসা করে যেত পণ্য খালাসকারী সংস্থাগুলি।
অনেকে মনে করছেন, এ বার সারা দেশে এই ছবিই আমূল বদলাতে পারে হলদিয়া-মডেলের দৌলতে। নিলামের ভিত্তিতে মার্চে দু’বছরের জন্য সংস্থা বাছাই করেছেন হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে বন্দর শুরুতেই ঠিক করে দিয়েছিল যে, পণ্য খালাসের জন্য টন পিছু ১১৯ টাকা ৪৮ পয়সার বেশি নিতে পারবে না কোনও সংস্থা। ফলে নিলামের বিষয় ছিল, ওই সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে কোন সংস্থা বন্দরকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব দিতে রাজি। দেখা যায়, একটি সংস্থা সর্বোচ্চ দর হেঁকেছে ১৪ টাকা ৭৭ পয়সা। এবং তা ঘোষণার পরে ওই একই দরে পণ্য খালাসে রাজি থাকার কথা জানায় আরও সাত সংস্থা। ফলে মোট আটটি সংস্থাকে পণ্য খালাসের লাইসেন্স দেন বন্দর কর্তৃপক্ষ।
হলদিয়ার এই নিলাম ব্যবস্থাকেই এখন দেশের সব বন্দরের জন্য মডেল করছে জাহাজ মন্ত্রক। সেই কারণেই ওই নীতি অবলম্বন করতে বলা হয়েছে দেশের ১২টি বড় বন্দরকে। যাতে আগের মতো সেখানে পণ্য খালাসের নিয়ন্ত্রণ মাত্র ১৫-২০টি সংস্থার হাতে কুক্ষিগত না-থাকে।
এক বন্দরকর্তার দাবি, সব মিলিয়ে পণ্য খালাসকারী সংস্থাগুলি বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে। বলতে গেলে এত দিন তা থেকে এক টাকাও সরকারি কোষাগারে আসত না। সেই ছবি এ বার বদলাবে। কারণ, পণ্য খালাসকারী সংস্থাগুলি রোজগারের একটি অংশ বন্দরের হাতে তুলে দিতে বাধ্য থাকায় ভাঁড়ারে চার হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত আসতে পারে।
বন্দর সূত্রে খবর, ইউপিএ জমানায় স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, কয়লা কেলেঙ্কারির সূত্র ধরেই গুঞ্জন শুরু হয় বন্দরে পণ্য খালাসের অব্যবস্থা নিয়ে। অভিযোগের আঙুল ওঠে সারা দেশে এই ব্যবসায় গুটিকয় সংস্থার আধিপত্যের দিকে। আর সেই কারণে দাবি ওঠে নিলামের মাধ্যমে সংস্থা বাছাইয়েরও। সেই সঙ্গে বলা হয় প্রতিযোগিতা বাড়ানোর কথা। যাতে কোনও বন্দরে কোনও নির্দিষ্ট সংস্থার মৌরসিপাট্টা কায়েম না হয়। দু’দিক থেকেই হলদিয়া-মডেল পথ দেখিয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
জাহাজ মন্ত্রক জানিয়েছে, ‘ট্যারিফ অথরিটি ফর মেজর পোর্ট’ (ট্যাম্প) প্রতি বন্দরে পণ্য খালাসের সর্বোচ্চ দর ঠিক করে দেব। তার আগে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে বন্দরের চেয়ারম্যানদের পণ্য খালাসের সম্ভাব্য খরচ ট্যাম্পের কাছে পাঠাতে হবে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ট্যাম্প প্রতিটি বন্দরে পণ্য খালাসের সর্বোচ্চ দর ঠিক করবে। তার পরেই আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে নিলাম করে পণ্য খালাসকারী সংস্থা নির্বাচন করবে বন্দরগুলি।
অবশ্য হলদিয়া বন্দরেও একটি সমস্যার কথা বলছেন অনেকে। তাঁদের অভিযোগ, খালাসকারী সংস্থা বন্দরের বেঁধে দেওয়া দর মানতে বাধ্য হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু মাঝেমধ্যেই কিছু টাকা বাড়তি চাইছে বিভিন্ন অজুহাতে। অনেকটা বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছতে এসে ১৫-২০ টাকা বাড়তি চাওয়ার মতো। হলদিয়া-সহ সব জায়গায় সেই সমস্যা কী ভাবে নির্মূল করা যায়, তা-ও খতিয়ে দেখছেন বন্দরকর্তারা।