মুখ্যমন্ত্রীকে বরণ। ইটাহারে হেলিকপ্টার থেকে নামার পর। ছবি: তরুণ দেবনাথ।
মঙ্গলবার মাঝেরহাটে মারোয়াড়ি সমাজের অনুষ্ঠানে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়েছিলেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’। তৃণমূল সূত্রই বলছে, যার মূল উদ্দেশ্য প্রথাগত ভাবে বিজেপি-ঘেঁষা অবাঙালি ভোটারকে নিজেদের দিকে টেনে আনা। কারণ, এ বার রাজ্যে বিজেপি ভোট বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রায় সব জনমত সমীক্ষা। বুধবার উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার ও মালদহে দলের কর্মিসভায় তৃণমূল নেত্রী স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিলেন, সিপিএম, কংগ্রেসের পাশাপাশি বিজেপি-কেও অন্যতম প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছেন তিনি।
২০০৯-এ লোকসভায় এ রাজ্য থেকে বিজেপি জিতেছিল মাত্র একটি আসনে। দার্জিলিং। এ বারও সেখানে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধায় তারা ভালই লড়াই করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তার বাইরেও বাকি ৪১টি আসনে কেন বিজেপি-কে বড় প্রতিপক্ষ বলে মনে করছে তৃণমূল? তার কারণ লুকিয়ে আছে জনমত সমীক্ষার ইঙ্গিতে। জানুয়ারির শেষে এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের প্রথম জনমত সমীক্ষা জানিয়েছিল, কোনও আসন জেতার অবস্থায় না-থাকলেও রাজ্যে বিজেপি-র ভোটের পরিমাণ বেড়ে হচ্ছে ১১ শতাংশ। এক মাস পরে দ্বিতীয় সমীক্ষায় তাদের ভোটের পরিমাণ আরও ১ শতাংশ বেড়েছে। ফলে এ বার চতুর্মুখী লড়াইয়ে ভোট কেটে বিজেপি যে অনেকেরই যাত্রা ভঙ্গ করতে পারে, সেই আশঙ্কা থাকছেই। আর যে হেতু রাজ্যে তৃণমূলের ভোটের পরিমাণই সব চেয়ে বেশি, তাই ভোট হারানোর ভয়ও বেশি তাদেরই।
এটা ঠিক, জনমত সমীক্ষা যে সব সময় মিলে যায়, এমন নয়। তবে ভোটদাতারা কী ভাবছেন তার ইঙ্গিত পেতে এ ধরনের সমীক্ষা যে কাজে আসে, তা-ও অস্বীকার করা যায় না। পরিস্থিতির এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই তৃণমূল নেত্রী এক দিকে যেমন ঐতিহ্যগত ভাবে বিজেপি-র ভোটব্যাঙ্ককে নিজের দিকে টানার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তেমনই অন্য দিকে দলীয় কর্মীদের কঠিন লড়াই সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন বলে তৃণমূল সূত্রের অভিমত। এ দিন ইটাহারের কর্মিসভায় মমতা বলেন, “কেউ কেউ হিন্দু-মুসলিম করে নির্বাচনের প্রচারে নেমে পড়েছে। তৃণমূলের ভোট কেটে কংগ্রেস ও সিপিএম-কে জেতানোই ওদের উদ্দেশ্য। যারা হিন্দু, মুসলিম, তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের কথা বলে বা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ তৈরি করার চেষ্টা করছে, তাদের বিশ্বাস করি না। তাই আপনারা সবাইকে নিয়ে এক হয়ে চলার চেষ্টা করুন।” পরে মালদহেও বিজেপি-কে তুলোধোনা করে মমতার মন্তব্য, “আমাদের রাজ্যে সাম্প্রদায়িক কোনও শক্তিকে জায়গা দেওয়া যাবে না।”
তৃণমূলের নিজস্ব মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থেও বিজেপি-কে আক্রমণ করা জরুরি বলে জানাচ্ছেন অনেক রাজনীতিক। বিশেষ করে ভোটের দিনক্ষণ প্রচারের আগে বিজেপি প্রসঙ্গে মমতার নীরবতা নিয়ে যখন প্রশ্ন তুলেছিলেন বিরোধীরা। কারণ, ৩০ জানুয়ারি ব্রিগেডের সভায় মোদীর নাম করেননি তৃণমূল নেত্রী। তার পর ফেব্রুয়ারির গোড়ায় ব্রিগেডে এসে তৃণমূলের সঙ্গে রাজনৈতিক সহাবস্থানের তত্ত্ব ভাসিয়ে জল্পনা আরও উস্কে দিয়ে যান বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। তিনি দাবি করেছিলেন, রাজ্যে তৃণমূল আর কেন্দ্রে বিজেপি থাকলে বঙ্গবাসী দু’হাতেই লাড্ডু পাবেন।
এর পরই সংখ্যালঘু ভোট বাঁচাতে মোদীর বিরুদ্ধে সরব হন মমতা। জানিয়ে দেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গোত মেলাবেন না তিনি। সোমবার পৈলানের কর্মিসভায় মমতা বলেন, “বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগেই অনেকেই নমো-নমো করতে শুরু করেছে। এমন একটা ভাব করছে যেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়েছে। বিজেপি কত আসন পাবে, তা আমি জানি। ওরা কিছু করতে পারবে না।”
আর এ দিন ইটাহার এবং মালদহ দুই জায়গাতেই তাঁর অভিযোগ, “এখন বিজেপি আর কংগ্রেসের আঁতাঁত হয়েছে। বিজেপি-কংগ্রেস বোঝাপড়া করে তেলঙ্গানা গড়েছে। সিপিএম-ও দোসর হয়েছে। বাংলা ভাগের ছক হচ্ছে। তাই আমাদের লড়াই কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপি-র বিরুদ্ধে।”
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অবশ্য বক্তব্য, লোকসভা ভোটে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ভাল ফল করবে বুঝতে পেরেই মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সভায় বিজেপি-কে আক্রমণ করছেন।
মোদীর বাড়িয়ে দেওয়া লাড্ডু যে তৃণমূলের মুখে রুচছে না, সেটা এখন স্পষ্ট।