মুকুলে আর মমতা নেই

বৈঠকে না থাকায় ক্ষুব্ধ নেত্রী, কাড়লেন দায়িত্ব

এত দিন ছিল পরোক্ষে। এ বার একেবারে প্রত্যক্ষ সংঘাত! সরাসরি মুকুল রায়ের ডানা ছাঁটার কাজে হাত দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ যাবৎ দলের মধ্যে মুকুল-অনুগামীদের ক্ষমতা খর্ব করে একাধিক বার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। এ বার নিশানায় চলে এলেন খোদ মুকুল! দল প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মুকুলই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এখনও গর্বের সঙ্গে সেই কৃতিত্বের দাবি করে থাকেন তিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:০২
Share:

—ফাইল চিত্র

এত দিন ছিল পরোক্ষে। এ বার একেবারে প্রত্যক্ষ সংঘাত! সরাসরি মুকুল রায়ের ডানা ছাঁটার কাজে হাত দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

এ যাবৎ দলের মধ্যে মুকুল-অনুগামীদের ক্ষমতা খর্ব করে একাধিক বার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। এ বার নিশানায় চলে এলেন খোদ মুকুল! দল প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মুকুলই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এখনও গর্বের সঙ্গে সেই কৃতিত্বের দাবি করে থাকেন তিনি। কিন্তু এ বার থেকে ওই পদে মুকুলের একচ্ছত্র অধিকার আর থাকছে না! শনিবার কালীঘাটে দলের বৈঠকে মমতা জানিয়ে দিলেন, মুকুলের সঙ্গে অতিরিক্ত সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব সামলাবেন সাংসদ সুব্রত বক্সী। দল প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই সুব্রতবাবু তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি। এত দিন দলের তরফে ভোট প্রক্রিয়ার যাবতীয় কাজ, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সবই নিজের হাতে সামলাতেন মুকুল। এ বার বক্সীকে নির্বাচন কমিশনের কাজও দেখভাল করার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা।

তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “মুকুলের জন্য শরশয্যা তৈরি করে দিলেন দলনেত্রী! এ বার মুকুলকেই ঠিক করতে হবে তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু নেবেন কি না!”

Advertisement

এর পরে কী করবেন তৃণমূলে এত দিনের ‘নম্বর টু’? সাম্প্রতিক কালের ঘটনাপ্রবাহে দলের ভিতরে-বাইরে এই জল্পনা ছিলই। এ দিনের বৈঠকের পরে সেই জল্পনাই বহু গুণ জোরালো হল। আর স্বয়ং মুকুলও জল্পনা উস্কে দিয়ে মন্তব্য করেছেন, “ক্ষমতা কেউ কাউকে দেয় না। ক্ষমতা অর্জন করে নিতে হয়!” তৃণমূলের একাংশের মতে, দলের সর্বময় নেত্রীর সঙ্গে এই প্রথম বার সম্মুখ সংঘাতে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন মুকুল।

রেলের সংস্থা আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদার চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরে দলনেত্রীর পাশে দাঁড়াননি মুকুল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওই চুক্তির সময় তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন না। যে মন্তব্যকে পূর্বসূরি মমতার উপরে দায় চাপানো হিসেবেই দেখেছিল তৃণমূল শিবির। আর

ওই মন্তব্যের পরেই মমতার সঙ্গে মুকুলের দূরত্বের সূত্রপাত। পরে ডেলোয় সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে বৈঠকের কথা ইঙ্গিতে কবুল করা, সিবিআইয়ের মুখোমুখি হয়ে অকুণ্ঠ সহযোগিতার কথা বলা এ সব থেকে সেই দূরত্ব আরও চওড়া হয়েছে।

মুকুল যত বেসুরে গেয়েছেন, ততই তাঁর হাত থেকে সংগঠনের দায়িত্ব কেড়েছেন মমতা। ভার দিয়েছেন ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মুকুল বিলক্ষণ জানেন, দলে যুবরাজের অধিষ্ঠান যত মজবুত হবে, তাঁর প্রভাব ততই কমে আসবে। মুকুলের সঙ্গে বক্সীকে জুড়ে দেওয়ার পাশাপাশিই সংগঠনে আরও যে সব রদবদল এ দিন মমতা করেছেন, তাতে অভিষেক-শিবিরের গুরুত্ব বৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। তাই ‘ক্ষমতা অর্জনে’র কথা বলে মুকুল একই সঙ্গে যুবরাজকেও খোঁচা দিয়েছেন বলে তৃণমূলের একাংশের ধারণা।

তবে অভিষেকও কৌশলে মুকুলকে জবাব ফিরিয়ে দিয়েছেন এ দিনই! তিনি বলেছেন, “মুকুলদার সঙ্গে আমি একমত! ক্ষমতা কেউ কাউকে দেয় না। কারণ, আমি ডায়মন্ড হারবার থেকে লড়াই করে জিতেছি!” অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, তথাকথিত কোনও নিরাপদ আসনে তাঁকে মমতা দাঁড় করাননি। তা হলে তিনি দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকেই জিতে আসতে পারতেন! ঘটনাপ্রবাহ দেখে তৃণমূলের রাজ্য নেতাদের অনেকেই দলের অন্দরে বলছেন, দুই কেন্দ্রে উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার আগেই মুকুল-অভিষেক দ্বৈরথ অন্য মাত্রা নিল।

বস্তুত, বনগাঁ লোকসভা ও কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের সঙ্গে এ দিনের মুকুল-বধ পালার সরাসরি সম্পর্ক আছে বলেই তৃণমূলের একটি সূত্রের ইঙ্গিত। শুক্রবার উপনির্বাচন চলাকালীন তৃণমূল নেত্রীর কাছে খবর আসে, নদিয়ার কল্যাণী-গয়েশপুর এলাকায় উপরে উপরে যা-ই হোক, আসলে দলের হয়ে কাজ করছে না মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায়ের বাহিনী। বরং, তারা তলে তলে সিপিএম-কে সাহায্য করছে বলেই দলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ সন্দেহ করছেন। শুভ্রাংশু নিজে বসে আছেন বাড়িতে। আর মুকুল মধ্যমগ্রামে দলীয় দফতরে বসে মোটেও এ সবে গা লাগাচ্ছেন না! ভোট চলাকালীনই মমতা ঠিক করে ফেলেন, শনিবার বৈঠক করবেন। উপনির্বাচন শেষ হওয়ার পরে দল ও প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর নিয়ে মধ্যরাতের পরে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ফোন যায় মুকুলের কাছে। মুকুল তখনও বিষয়টিকে আমল দেননি বলে একটি সূত্রের খবর।

মুকুল তখন থেকেই জানতেন, এর পরে কালীঘাট গেলে তাঁকে দলে সর্বসমক্ষে তোপের মুখে পড়তে হবে। ঠিক যেমন হয়েছিল সিবিআই জেরার পর দিন কালীঘাটের বৈঠকে গিয়ে! তাই এ দিন তিনি কালীঘাট-মুখোই হননি! ঘনিষ্ঠ মহলে মুকুল অবশ্য এ সব কাহিনিই অস্বীকার করে দাবি করেছেন, ভোট মিটে যাওয়ার পরে তিনি রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন! যদিও কালীঘাটে এ দিনের বৈঠকের অন্দরের কিস্সা আগের দিনের টানাপড়েনের দিকেই ইঙ্গিত করছে।

তৃণমূল সূত্রের খবর, কালীঘাটে এ দিনের আলোচনা শুরুই হয় নাটকীয় ভঙ্গিতে। দলনেত্রীর এক পাশে বসেছিলেন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অন্য পাশে বক্সী। দলের রাজ্য সভাপতির কাছে মমতা জানতে চান, মুকুল কোথায়? আসেনি কেন? এলে ভাল করত! বক্সী তাঁকে একটি চিরকুট দেখিয়ে জানান, মুকুল বিশেষ কাজে ব্যস্ত। ক্ষুব্ধ মমতা তখন বলেন, আজকাল সব সময়েই মুকুলের বিশেষ কাজ থাকছে! তিনি ডাকলেও তা-ই! সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের কোনও দায়িত্বই তো পালন করতে দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। শুধু তা-ই নয়, মুকুল আজকাল তাঁকে সব কাগজপত্রও ঠিকমতো দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন মমতা! “দলের কাজই তো সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ!” বৈঠকে মমতাকে এমন মন্তব্য করতেও শুনেছেন নেতারা।

ঠিক দু’সপ্তাহ আগে মুকুল সিবিআই দফতরে হাজিরা দিয়ে আসার পরের দিন কালীঘাটে দলীয় বৈঠকে মুকুলের উপস্থিতিতেই মমতা একই ভাবে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “জানি না, মুকুলকে ওরা (সিবিআই) কী জিজ্ঞাসা করেছে?” যার অর্থ ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সিবিআই জেরার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও দলনেত্রীকে অবহিত করেননি মুকুল।

দলনেত্রীর সে দিনের মনোভাবের সঙ্গে তাঁর এ দিনের সিদ্ধান্তের যোগসূত্রই দেখছেন তৃণমূল নেতারা। দলের এক নেতার বক্তব্য, মুকুলের নাম না করে মমতা বৈঠকে বলেছেন, কারও সঙ্গে দল খারাপ ব্যবহার করেনি। যাঁরাই সিবিআইয়ের ডাক পেয়েছেন, তাঁদের পাশেই দল দাঁড়িয়েছে। কেউ যদি নিজে থেকে বৈরিতা বা দূরত্ব তৈরি করেন, তা হলে আর কী করা যাবে!

ওই নেতা আরও জানান, দলনেত্রীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির পরে মুকুল দলে কাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, সেই খবরও আছে মমতার কাছে। বৈঠকের পরেও এ দিন তাঁদের কাউকে কাউকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন মমতা। সেই আলাপচারিতাতেও তৃণমূল নেত্রীর বার্তার মূল নির্যাস মুকুল যা করছেন, আদপেই ঠিক করছেন না! কত লোক তাঁর সঙ্গে আছেন, সেই ‘নম্বরে’র জোর দেখিয়ে লাভ নেই!

প্রকাশ্যে অবশ্য দু’পক্ষই এই ফাটল ঢাকার চেষ্টা করেছেন। মুকুল যেমন দাবি করেছেন, “আমি দলেরই কাজে ব্যস্ত আছি। তাই বৈঠকে যাইনি। দলীয় নেতৃত্ব তা জানেন।” ‘যুবরাজ’ অভিষেকও বলেছেন, “মুকুলদা দলকে জানিয়েছিলেন, তিনি বৈঠকে থাকতে পারবেন না।” আর পার্থবাবুর মন্তব্য, “মুকুলকে নিয়ে সংবাদমাধ্যম যে বিরূপ খবর তৈরি করছে, তার সঙ্গে আমি একেবারেই একমত নই! মুকুল তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে দলের সঙ্গে আছেন, এখনও তিনি একই ভাবে দলের কাজে যুক্ত।”

কিন্তু সংগঠন পুনর্বিন্যাসের খবরে স্বয়ং মুকুলের প্রতিক্রিয়া অন্য ছবিই তুলে ধরছে। স্পষ্ট অভিমানের সুরে তিনি বলেছেন, “ভালই তো। সংগঠন বড় হচ্ছে। তাই নতুন অনেককে দায়িত্ব দিতে হয়েছে। এতে সংগঠনের কাজ ভাল হবে।”

অভিমান মকুলকে কোন পথে নিয়ে যায়, আপাতত সেই জল্পনাতেই মশগুল তৃণমূল!

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন