দল তো একটাই। এক একটা এলাকায় এক এক জন নেতা তা হলে দলের মধ্যে প্রায় আর একটা দল খুলে বসছেন কেন? প্রশ্নটা বিরোধীদের বা সংবাদমাধ্যমের নয়! খাস শাসক দলের বিধায়কদেরই একাংশের!
ভদ্রেশ্বরের নর্থব্রুক জুটমিলের ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বৈঠকে ডাকা হয়েছিল সেই সব তৃণমূল বিধায়কদের, যাঁদের এলাকায় চটকল আছে। সেখানেই দুই ২৪ পরগনা ও হাওড়া থেকে কয়েক জন বিধায়ক প্রশ্ন তুলেছেন, বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা নেতারা নিজেদের মতো করে দলের শ্রমিক ইউনিয়ন আইএনটিটিইউসি-র ইউনিট খুলে ফেলেছেন! কার কথা তা হলে কে শুনবে? ওই বৈঠকে প্রশ্নটা শ্রমিক ইউনিয়নকে ঘিরে উঠলেও তৃণমূলের অন্দরে এখন এটাই সার কথা! চতুর্দিকে অজস্র নেতা এবং তাদের বহু গোষ্ঠী। আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় যাদের মধ্যে এখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখছে পশ্চিমবঙ্গ! লোকসভা ভোটের পরে শাসক দলের গোষ্ঠী-সংঘর্ষে কখনও প্রাণহানি ঘটছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘিতে, কখনও উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চলের পানিহাটিতে। সংঘর্ষের রেশ বীরভূম থেকে হুগলি, দুই মেদিনীপুর থেকে বর্ধমান বা কলকাতার কাছে নিউটাউন-রাজারহাট থেকে দমদম ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।
তৃণমূলেরই এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “এখন যা শুরু হয়েছে, মহাভারতের মুষল-পর্বের মতো! এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে না-পারলে যদু বংশ এই সংঘর্ষেই ধ্বংস হতে পারে!” পরিস্থিতি যে ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, বুঝতে পারছেন তৃণমূল নেতৃত্বও। স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব একাধিক বার এই নিয়ে সতর্ক-বার্তাও জারি করেছেন দলে। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজের কাজ হওয়ার কোনও লক্ষণই নেই। বরং, বুধবার রাতে ব্যারাকপুরে তৃণমূলের আইনজীবী-নেতা রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নিজের চেম্বারে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে উত্তর ২৪ পরগনা থেকে দলের একাধিক বিধায়ক ঘনিষ্ঠ মহলের আলোচনায় আশঙ্কা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন, “কখন আমাদের কার উপরে হামলা হয়, কোনও ঠিক নেই!”
শাসক দলের মধ্যে গোষ্ঠী-বিবাদ বাম আমলেও ছিল। কিন্তু তৃণমূল জমানার মতো এমন খোলাখুলি এবং বেপরোয়া ভঙ্গিতে ছিল না। তৃণমূলের মতো দলেও গোষ্ঠী-কাজিয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয়, লোকসভা ভোটের পরে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ বিবাদ একেবারে রাস্তায় নেমে রক্তপাত ঘটাচ্ছে। কখনও বিবাদ বাধছে সিন্ডিকেটকে কেন্দ্র করে, কখনও সটান তৃণমূলের কার্যালয়ের মধ্যে ঢুকে খুন করে দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় কোনও নেতাকে! লোকসভা ভোটে রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের বিপুল সাফল্যের পরে কেন এমন পরিস্থিতি? দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের জেলা স্তরের নেতাদেরও আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা, লোকসভা ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে মরিয়া হয়ে এলাকায় এলাকায় অশান্তি বাধাচ্ছে সিপিএম। তাদের পিছন থেকে মদত দিচ্ছে বিজেপি। দু’দিন আগে পানিহাটির খুন বা ব্যারাকপুরে বুধবার রবীনবাবু গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি এবং রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক যেমন সিপিএম-বিজেপি’র দিকেই আঙুল তুলেছেন। অস্ত্র উদ্ধারের দাবিও তুলেছেন।
আর গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব নিয়ে যে কোনও প্রশ্নেই মুকুলবাবুর সহাস্য জবাব, “আমাদের দলে কোনও গোষ্ঠী নেই। বিবাদও নেই!”
সে সবই অবশ্য প্রকাশ্যে। তবে দলের অন্দরে তৃণমূলের নেতারাই এমন তত্ত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ঘোরতর সন্দিহান! উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চল-সহ রাজ্যের বহু এলাকাতেই এ বার সিপিএম-সহ বিরোধীরা এজেন্ট পর্যন্ত দিতে পারেনি। দিলেও তাঁদের বুথ ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছে। তৃণমূলের নেতারা তখন প্রশ্ন তুলেছেন, বিরোধীরা যদি লোকজন না পায়, তো কী আর করা যাবে? তৃণমূলের অভ্যন্তরেই প্রশ্ন আছে, সাংগঠনিক ভাবে বেহাল হয়ে যারা ভোটে এজেন্ট দিতে পারে না, তারা শাসক দলের নেতা-কর্মীদের উপরে দিনের পর দিন আক্রমণ চালাবে কী ভাবে!
নেতারা প্রকাশ্যে যেমনই দাবি করুন, তৃণমূল সূত্রের আলোচনায় কয়েকটি কারণের কথা বেশি করে উঠে আসছে। শাসক দলেরই এক নেতার কথায়, “এ বারের লোকসভা ভোট ছিল খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে। যে ভাবেই হোক, এমন কঠিন নির্বাচনে এত আসন জেতার পরে এলাকায় এলাকায় দলের নেতাদের মাথায় ঢুকে গিয়েছে আমাদের আর কিছুতেই যায় আসে না!” ওই নেতার ব্যাখ্যা, লোকসভা ভোটে জিতে প্রার্থীরা সাংসদ হলেও তৃণমূল স্তরে আসলে লড়াইটা লড়েছেন পুরসভার কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত সদস্যেরা। তার উপরে বিধায়কেরা। তাঁদের একটা বড় অংশই মনে করতে শুরু করেছেন, আধিপত্য বিস্তারের এটাই সুযোগ। বিরোধীরা কোণঠাসা। জনমত তাঁদের পক্ষে। অতএব, দলের মধ্যে আরও বড় হওয়ার আদর্শ সময়! যাঁরা পরে দলে এসেছেন, তাঁরা ‘আদি’দের উপরে ছড়ি ঘোরাতে মরিয়া। আবার তাঁদের রমরমা ঠেকাতে তৈরি অন্যান্য গোষ্ঠী! বিবাদের মশলা একেবারে ভরপুর!
তৃণমূলের এক দাপুটে বিধায়ক উল্লেখ করছেন আরও একটি বিষয়ের কথা। তাঁর বক্তব্য, বাম জমানায় পুলিশ-প্রশাসনকে হামেশাই শাসক দলের পক্ষে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন শাসক দলেরই একটি অংশকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য অন্য অংশ পুুলিশকে ব্যবহার করছে। ওই বিধায়কের অভিযোগ, “আইনশৃঙ্খলা সামলানোর বদলে পুলিশ যদি শাসক দলের কোনও দাদাকে সুখী এবং কোন ও দাদাকে দুখী রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তার ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে!” তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, লোকসভা ভোটে সাফল্যের আবহেও যে সব এলাকায় দলের ফল অপেক্ষাকৃত উদ্বেগজনক হয়েছে, সেখানেই পুলিশ-প্রশাসনকে হয় নিষ্ক্রিয় রেখে দলের একাংশ অন্য অংশের উপরে হামলা চালাচ্ছে। নয়তো পুলিশকেও কৌশলে গোষ্ঠী-স্বার্থ মেটাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। আক্রান্ত অংশ আবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকছে পাল্টা আঘাত হানার জন্য। ব্যারাকপুরে রবীনবাবুর উপরে হামলাকে যেমন সম্প্রতি শিবু যাদবের গ্রেফতারির পাল্টা হিসাবেই দেখছে স্থানীয় তৃণমূল শিবির।
ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূলের অন্দরে গোলমালের সূত্রপাত মুখ্যত হয়েছিল ইট-বালি-পাথর সরবরাহের সিন্ডিকেট দখলকে ঘিরেই। তৃণমূল সূত্রের ইঙ্গিত, শিল্পাঞ্চল বা শহুরে এলাকায় এখন বিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে এলাকায় বালি খাদানের ব্যবসা, ছাঁটাই লোহা বিক্রি, নার্সিং হোমে আয়া সরবরাহ-সহ আপাতদৃষ্টিতে নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে! দলের এক সাংসদকে যেমন আড়ালে ‘কলম্বাস’ বলে ডাকেন তাঁরই সতীর্থেরা! কারণ, তোলা আদায়ের নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের আশ্চর্য ক্ষমতা নাকি তাঁর আছে! এখন আর শুধু এক জন নয়, গোটা শাসক দলের অন্দরেই কলম্বাসের ছড়াছড়ি!
গোষ্ঠী-বিবাদের মধ্যেও আবার জেলা ভেদে প্রকারভেদ আছে। যে সব জেলায় দু-এক জন নেতার আধিপত্য প্রশ্নাতীত, সেখানে তাঁর বা তাঁদের বিরোধী গোষ্ঠী থাকলেও তারা তুলনামূলক ভাবে সংযত আছে এখনও। যেখানে নেতারা কেউ কাউকে মানতে প্রস্তুত নন, সেখানে গোলমালও বেশি। উদাহরণ, উত্তর ২৪ পরগনা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি আয়ত্তে আসার কোনও সম্ভাবনা আছে কি? তৃণমূলের অন্দরে একান্ত আলোচনায় উত্তরটা নেতিবাচকই। যেমন, একটি জেলার বিবদমান দুই মন্ত্রীকে সম্প্রতি আলাপচারিতায় দেখে তাঁদের এক জনের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, বিবাদ কি মিটে যাচ্ছে? মন্ত্রীর জবাব, “মিটে যাওয়া, না-যাওয়ার কিছু নেই! আমি সাদাকে সাদা বলব, কালোকে কালো। যার পছন্দ হবে না, হবে না!” বোঝাই যাচ্ছে, শুধু নেতাদের সতর্ক-মন্ত্রে যদু-বংশে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ!