ব্যঙ্গ-বাণ ঠেকাতে সোশ্যাল সাইটে নজর রাখবে রাজ্য

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের দুই নেতা মুকুল রায় ও দীনেশ ত্রিবেদীকে নিয়ে করা একটি ব্যঙ্গচিত্র সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে শেয়ার করে হাজতবাস করতে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। সে বছর দুয়েক আগের কথা।

Advertisement

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০১
Share:

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের দুই নেতা মুকুল রায় ও দীনেশ ত্রিবেদীকে নিয়ে করা একটি ব্যঙ্গচিত্র সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে শেয়ার করে হাজতবাস করতে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। সে বছর দুয়েক আগের কথা। রাজ্য সরকারের আশায় ছাই দিয়ে সেই ঘটনার পরে মন্ত্রী-সান্ত্রীদের নিয়ে কটাক্ষ কমার বদলে বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ! ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি এখন উপচে পড়ছে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের নেতাদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র-ছড়া-কবিতায়। এই পরিস্থিতিতে ওই সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পাকাপাকি ভাবে নজরদারি চালাতে কোমর বেঁধে নামছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এ জন্য লোক নিয়োগের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

বছর দুয়েক আগে অম্বিকেশবাবুকে গ্রেফতারের সময় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে মমতা-বিরোধী সমালোচনা এত তীব্র ছিল না। কিন্তু তার পরে দিন যত গড়িয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূল নেতাদের বিভিন্ন মন্তব্য ও কাজকর্ম নিয়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের নানা স্তরে। আর তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে। বস্তুত, সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে এই সব সাইটগুলিতে মমতা-বিরোধী সমালোচনা ও বিদ্রুপের বহর বেড়েছে। সেটাই আরও ব্যাপ্তি পেয়েছে সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের হাতে তৃণমূলের একের পর এক প্রথম সারির নেতা গ্রেফতারের পরে। মান্না দে-র অতি পরিচিত গানের প্যারোডি ‘ডেলো পাহাড়ের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ বা আদি তুঘলক বনাম নব তুঘলক বা ‘সারদাকাব্য’ নাম দিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘এত ক্ষণে মুখ্যনেত্রী কহিলা বিষাদে, জানিনু কেমনে সিবিআই প্রবেশিল তৃণমূলপুরে’-র মতো অসংখ্য ব্যঙ্গ-কবিতা ঝড় তুলে দিয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে। আর অসংখ্য ব্যঙ্গ-চিত্র তো রয়েইছে।

এই পরিস্থিতিতে সোশ্যাল সাইটগুলির উপরে নজরদারি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য পুলিশ। গত ১৯ জানুয়ারি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর এই মর্মে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে, সেখানেই এই নজরদারির কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিধাননগর কমিশনারেটের অধীনে ওই ‘সাইবার পেট্রল সেল’ তৈরি হবে। এ জন্য সফটওয়্যার সম্পর্কে পড়াশোনা আছে এমন ৯৬ জনকে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে। এই কর্মীদের বেতন বাবদ বছরে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার অনুমোদনও দিয়েছে অর্থ দফতর। বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, “সাইবার পেট্রল সেল তৈরির প্রস্তাব আমরাই ডিজি-কে দিয়েছিলাম। তিনি ওই প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠান। মন্ত্রিসভা তাতে অনুমোদন দেয়।”

Advertisement

কিন্তু কমিশনারেটের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগের অধীনে একটি ‘সাইবার ক্রাইম সেল’ থাকা সত্ত্বেও কেন পৃথক ‘সাইবার পেট্রল সেল’ তৈরির দরকার পড়ল? বিধাননগর পুলিশের ওই কর্তা বলেন, “সাধারণ মানুষই শুধু নয়, সন্ত্রাসবাদীরাও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিকে ব্যবহার করছে। তাই সেগুলির উপরে নজরদারি করা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে।” যদিও ওই কর্তার যুক্তি হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে পুলিশেরই একটা বড় অংশ। একই প্রতিক্রিয়া প্রশাসনের বিভিন্ন মহলেও। তাঁদের বক্তব্য, তা-ই যদি হয়, তা হলে ওই ‘সাইবার পেট্রল সেল’ কেন কেন্দ্রীয় ভাবে তৈরি করা হল না? কেন একটা কমিশনারেটের হাতে তা তুলে দেওয়া হল? রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, “রাজ্য পুলিশের সদর দফতর ভবানী ভবনে ওই সেল খোলা উচিত ছিল। কারণ সোশ্যাল সাইটে নজরদারি তো কেবল বিধাননগরে আটকে থাকবে না। গোটা রাজ্যই থাকবে ওই প্রক্রিয়ার আওতায়।”

প্রশ্ন এটাও, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে নজরদারি চালিয়ে কী করবে সরকার? অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতার করে শুধু সারা রাজ্যে নয়, দেশেরও বিভিন্ন প্রান্তে মুখ পুড়েছিল মমতার সরকারের। তা ছাড়া, এই সব ব্যঙ্গ-চিত্র বা কবিতাকে কি এত সহজে ঠেকানো যাবে? অম্বিকেশবাবুকে গ্রেফতারের পরে তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশ জেনেছিল, মমতা-মুকুলের ব্যঙ্গচিত্রটি তিনি তৈরি করেননি। সেটি কয়েক জনের ই-মেলে ‘ফরওয়ার্ড’ করেছিলেন মাত্র। কিন্তু কোথা থেকে ওই ছবি তিনি পেয়েছিলেন, তা জানা পারেনি পুলিশ। ওই ঘটনার দিন চারেকের মধ্যে একই ধরনের অন্য একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল বিধাননগর পুলিশের কাছে। সল্টলেকের এক বাসিন্দার বিরুদ্ধে সোশ্যাল সাইটে মুখ্যমন্ত্রীর নামে কুৎসা রটানোর নালিশ জানিয়ে এফআইআর করেছিলেন বিধাননগরেরই এক তৃণমূল নেতা। যদিও অম্বিকেশ-কাণ্ডে মুখ পুড়িয়ে সেই ঘটনা নিয়ে বেশি এগোয়নি পুলিশ।

এমন কিছু নমুনা তুলে প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, এই যদি অবস্থা হয়, তা হলে এ ভাবে নজরদারি চালিয়ে সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ করে লাভ কী? তাঁদের প্রশ্ন, এ সব করে অম্বিকেশবাবুর মতো আরও বহু লোককে হেনস্থা করার চেষ্টা হচ্ছে না তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন