বিসর্জনের বাজনায় মনমরা পদাতিক ভোটবাহিনী

ভোট নাকি তাঁদের জীবনে বয়ে আনে নতুন প্রেমের উত্তেজনা। নিজেকে হঠাৎ ‘স্পেশ্যাল’ মনে হয়। এই ভোট যাই-যাই পর্বে তাই তাঁদের মন কেমন। প্রেম চলে যাচ্ছে! আবার শুরু হবে সেই গতানুগতিক দিনযাপন। তাঁরা মানে কারা?

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০৩:৫২
Share:

ভোট নাকি তাঁদের জীবনে বয়ে আনে নতুন প্রেমের উত্তেজনা। নিজেকে হঠাৎ ‘স্পেশ্যাল’ মনে হয়। এই ভোট যাই-যাই পর্বে তাই তাঁদের মন কেমন। প্রেম চলে যাচ্ছে! আবার শুরু হবে সেই গতানুগতিক দিনযাপন।

Advertisement

তাঁরা মানে কারা?

রাজনৈতিক দলের নীচের তলার একনিষ্ঠ কর্মী এঁরা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান বলে দুর্নাম রয়েছে। ‘পার্টি-পার্টি’ করে উদয়াস্ত দৌড়ে বেড়ানোর জন্য পারিবারিক জীবনে বিস্তর ঝামেলাও আছে। বিলক্ষণ জানেন, ভোট উতরে গেলে উপরমহলের খাতিরও কমে আসবে। তবু ভাল লাগে ক’দিনের জন্য পাওয়া গুরুত্বে গা ভাসাতে। জীবনটা কোথাও যেন চকচকে হয়ে ওঠে। তাই ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতি ভোটেই।

Advertisement

এই যেমন অরুণ মান্ডি। লোকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য ছুটি জমায়, আর ইনি বহু কষ্টে জমিয়ে রাখা ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ আর ‘আর্নড লিভ’গুলো ভোটের আগে নিয়েছিলেন। স্ত্রীকে বলে দিয়েছিলেন ‘‘সামনের একটা মাস শুধু রত্না দে নাগ আর মুনমুন সেনের জন্য সময় দেব। এতে রাগলে চলবে না!”

তৃণমূলের এই দুই প্রার্থীর প্রচার সভাতেই সিঙ্গুরের তরুণ স্কুলশিক্ষক অরুণবাবু ছিলেন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। আদি বাড়ি সারেঙ্গায়। কখনও হুগলির সভায় খোলা গলায় নিজের লেখা এবং সুর করা তৃণমূলীয় সঙ্গীত শুনিয়েছেন, আবার কখনও বাঁকুড়ায় কর্মিসভা জমাতে সাঁওতালি ভাষায় দাপিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। জীবনবিজ্ঞানের মাস্টারমশাইয়ের দর্শন একেবারে পরিষ্কার, “আমাদের মতো পাগলাটেরা না-থাকলে কোনও পার্টি থাকবে না। প্রার্থীদের তো ভোটে কিছু করার নেই। যা করার আমরা করব। ওঁরা শুধু হাসবেন আর হাত নাড়বেন। ভোটটা আমাদেরই জিতিয়ে দিতে হবে। আমরাই যে আসল কিংমেকার, ভোটের সময় এই ফিলিংটাই খুব থ্রিলিং।”

থ্রিল বলে থ্রিল!

জনসভা কি রোড শো, লোক জড়ো করা, ম্যারাপ বাঁধা, দেওয়াল লেখার তত্ত্বাবধান, বাড়ি-বাড়ি প্রচার, বিরোধী দলকে নরমে-গরমে সামলানো থেকে শুরু করে প্রার্থীর দুপুরের ঘুম, রাতের খাবার, গালে ঘষার বরফ, গাড়ির তেল, মায় গলা ব্যথার গরম জল পর্যন্ত স-অ-অ-ব দায়ভার কাঁধে নেওয়ার উত্তেজনা। তাতেই এমন সেঁকে থাকেন যে, অল্প-আধটু ব্যঙ্গও গায়ে লাগে না এই মানুষগুলোর।

এই সে দিন পর্যন্ত পাড়ার কিছু ডেঁপো ছেলে বিমানদাকে খেপিয়েছে “বাপ্পি যাবে হুডখোলা জিপে, সঙ্গে যাবে কে? ঘরে আছে বিমান-হুলো কোমর বেঁধেছে।” তা বলে কি বিমান ভট্টাচার্য গাল ফুলিয়ে ঘরে বসে থেকেছেন? উল্টে শ্রীরামপুর কোর্টের এই করণিক বাপ্পিদাকে কোর্ট ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। যখনই প্রার্থী প্রচারে বার হয়েছেন, তাঁর গাড়ির চারপাশ ঘিরে রাখা মোটা দড়ি নিজের কোমরে বেঁধে টেনে নিয়ে গিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বৌ রাগারাগিও করেছেন। মুচকি হেসে বলছেন, “প্রথম প্রথম মা-ও এই রকম আপত্তি করত। তখন নেতাদের ধরেটরে শ্রীরামপুরে ২৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে মা-কে পুরভোটে দাঁড় করিয়ে দিলাম। হেরে গিয়েছিল, কিন্তু তার পর থেকে আর খিটখিট করেনি। বৌয়ের জন্যও এমন একটা কিছু উপায় বার করতে হবে।” ভোট মিটে যাওয়ার পর এখনও কোর্টের কাজে মন বসেনি তাঁর।

যাদবপুরের অভিজিৎ ঘোষ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন্সে স্নাতক হওয়ার পর মাস দুয়েক আগে হায়দরাবাদে নামী সংস্থার চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরিটা নেননি, স্রেফ ভোটে দলের কাজ করবেন বলে। বয়স ২৫। জিন-এ রাজনীতি আছে। বামপন্থী বাড়ি। ক্লাস এইট-নাইনে পড়ার সময় থেকেই ব্রিগেড যাওয়া, ভোটের সময় ব্যানার-পতাকা বানানো দিয়ে শুরু করেছিলেন। প্রাপ্তবয়স্ক হতে না হতেই নাম লেখান ডিওয়াইএফে। লোকসভা ভোটে সুজন চক্রবর্তীর প্রচার টিমের অন্যতম কুশীলব ছিলেন অভিজিৎ। দম ফেলার ফুরসত ছিল না ক’দিন। প্রচার-পর্বের একেবারে গোড়ার দিকে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে মানুষের কথা শুনে এসে নেতাকে লাগাতার ফিডব্যাক দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। রোজই গভীর রাত পর্যন্ত মিটিং। স্বীকার করছেন, মঙ্গলবার থেকে সময়টা বড্ড খালি-খালি লাগবে।

যেমন লাগছে আমহার্স্ট স্ট্রিটের অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়ের। প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মীটি এত দিন ব্যস্ত ছিলেন সোমেন মিত্রের প্রচারে। যদিও চতুর্থ দফার ভোট শেষ হতেই মনের মধ্যে নেমে এসেছিল দশমীর বিকেল। গত ৪২ বছর ধরে সোমেনবাবুর সঙ্গেই প্রথমে কংগ্রেসে, মাঝে তৃণমূলে, তার পর কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন। বিয়ের পর-পর রাজনীতি নিয়ে এই পাগলামির জন্য স্ত্রী অনুযোগ করতেন। তখনই তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, “দ্যাখো, আমি মদ খাই না, সিগারেট-বিড়ি খাই না, সিনেমা দেখি না, কোনও নেশা নেই। পার্টি করাটাই একমাত্র নেশা। এটা মানিয়ে নাও।” মেনে নিলেন, এই ঝোড়ো দু’মাসের পর আবার ‘ম্যাদামারা’ জীবনযাত্রায় নিজেকে মানাতে হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে।

একই কষ্টে জর্জরিত রামপুরহাটের অর্ণব গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কালুদা। শতাব্দী-অন্ত জীবন তাঁর। দুঃস্বপ্ন দেখেন শতাব্দী রায় ভোটে লড়ছেন, অথচ তিনি প্রচারের কাজ করতে পারছেন না! ভোট ঘোষণার পর থেকেই নিজের ট্রান্সফর্মার সারানো আর স্টোনচিপস ভাঙার ব্যবসায় তালা দিয়েছিলেন। বললেন, “আসলে দলের সবাই বলে, ভোটের সময় কালু না হলে ওদের চলে না। আমি হলাম দিদি (পড়ুন শতাব্দী)-র সবচেয়ে কনফিডেন্সের জায়গা। প্রচারে বেরিয়ে গাড়ির তেল লাগলেও আমি, মাথা ধরলেও আমি। বাড়ির লোক জানে, এই সময় কারও কোনও বারণ শুনব না।” এখন ভোটও শেষ, জীবনও শতাব্দী ঘুরে-ফিরে স্টোনচিপস-এ!

রায়গঞ্জে মহম্মদ সেলিমের প্রচারে দিনরাত এক করে ফেলেছিলেন রাজু সাহা। রাজনীতি করতে গিয়েই বিয়ে করতে দেরি করে ফেলেছেন। শেষমেশ বাড়িতে যখন এক্কেবারে নতুন বিয়ে করা বউ, ঠিক তখনই শিয়রে ভোটের টান! কী দোটানা! প্রচারের ফাঁকেই রোজ দুপুরবেলা

এক বার করে বাড়ি গিয়ে নতুন বৌয়ের মুখখানা দেখে এসেছেন। তাতে নাকি ভোটের কাজে ম্যাজিকের মতো দ্বিগুণ শক্তি পেয়েছেন। বৌ-ও খুশি। কিন্তু এখন আফশোস রাজুর, “যে মজা অল্প পাওয়ায় মধ্যে আছে, সে কি ইচ্ছেমতো যখন-তখন পাওয়ায় থাকে? ভোট শেষ হয়ে ‘এক পলকে একটু দেখা’র আমেজটাই মাঠে মারা গেল!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন