দেবাশিস দাস
রহস্যময় ভাবে মৃত্যু হল কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বড় শ্যালকের। রবিবার ভোরে বিহারের বারসই স্টেশনের কাছে রেললাইনে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে জিআরপি। মৃত দেবাশিস দাস (৪৫) শোভনবাবুর স্ত্রী রত্নাদেবীর বড় ভাই। তাঁর মা কস্তুরী দাস মহেশতলার তৃণমূল বিধায়ক। মৃত্যুর কারণ নিয়ে পুলিশ এখনও ধন্দে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ সফর সেরে মেয়র শনিবার কলকাতায় ফিরেছিলেন। এ দিন ঘটনার কথা জানার পরে তিনি মালদহে চলে যান। কাটিহার জেলা হাসপাতালে ময়না-তদন্তের পরে সেখানেই দেবাশিসবাবুর দেহ আনার কথা।
রেল-পুলিশের খবর: এ দিন সকাল ছ’টা নাগাদ বারসই স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের কিছুটা দূরে, জলপাইগুড়িগামী চার নম্বর লাইনের মাঝে দেবাশিসবাবুর মৃতদেহটি লম্বালম্বি অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন পড়ে থাকতে দেখেন আরপিএফ কর্মীরা। মাথার পিছনে, ডান পায়ে ও কোমরে গভীর ক্ষত ও চোট ছিল। প্যান্টের পকেটে পাওয়া ভোটার কার্ডের ঠিকানা দেখে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা থানা মারফত দেবাশিসবাবুর বাড়িতে যোগাযোগ করা হয়। মৃতদেহের ছবি পাঠিয়ে নিশ্চিত করা হয় যে, মৃত ব্যক্তি দেবাশিস দাসই।
জানা গিয়েছে, মহেশতলার বাসিন্দা দেবাশিসবাবু পারিবারিক হোটেল ব্যবসার তদারকি করতে নিয়মিত উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করতেন। জলপাইগুড়ির মালবাজারে তাঁদের একটি হোটেল রয়েছে। মালবাজারের ছ’কিলোমিটার দূরে তেশিমিলা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় রয়েছে বাইশ বিঘের খামারবাড়ি।
এবং ওঁর মৃত্যু ঘিরে ধোঁয়াশাও রয়েছে। কী রকম?
প্রথমত, দুর্ঘটনাবশত ট্রেন থেকে পড়ে তিনি মারা গিয়েছেন, নাকি অন্য কোনও ভাবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। রেল-পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য: দেবাশিসবাবু কোনও কারণে ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে থাকলে দেহ লাইনের ধারে ছিটকে পড়ার কথা। কিন্তু দেহটি পড়ে ছিল লাইনের মাঝে। দ্বিতীয়ত, যেখানে দেহ মিলেছে, তার ক’ফুট দূরে একটি বিদ্যুতের পোস্ট। রেল-পুলিশের মতে, চলন্ত ট্রেন থেকে ঝুঁকে দাঁড়ানোয় পোস্টে মাথায় আঘাত খেয়ে যদি তিনি ছিটকে পড়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রেও দেহ লাইনের মাঝে পড়ার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া তখন আঘাত লাগার কথা মাথার সামনে। অথচ দেবাশিসবাবুর মাথার পিছনে গভীর ক্ষত পাওয়া গিয়েছে। ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে ছিল ঘিলু ও রক্ত। “এমনও হতে পারে, ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েই উনি মারা গিয়েছেন। স্থানীয় দুষ্কৃতীরা দেহটি লাইনের মাঝখানে রেখে পালিয়েছে।” বলেন এক তদন্তকারী।
বারসই স্টেশনের কাছে রেললাইনের এই অংশেই মিলেছিল
দেবাশিস দাসের দেহ। ছবি: অভ্রনীল রায়
কিন্তু ঘটনা হল, দেবাশিসবাবুর পকেটে একটি আংটি, সাড়ে সাত হাজার টাকা ও বর্ধমান থেকে কোচবিহার পর্যন্ত ট্রেনের জেনারেল ক্লাসের টিকিট পাওয়া গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, দুষ্কৃতীরাই যদি দেহ সরিয়ে থাকে, তা হলে টাকা-আংটি চুরি করল না কেন? উপরন্তু বাড়ির লোকের দাবি, দেবাশিসবাবু সাধারণত বাতানুকূল কামরায় যাতায়াত করতেন। এ বার কেন সাধারণ কামরায় উঠলেন, সেটাও তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে। সাধারণ টিকিটে ট্রেন ও যাত্রীর নাম উল্লেখ থাকে না। রেল-পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সম্ভাব্য সময়ে বারসই দিয়ে উত্তরবঙ্গ, কামরূপ ও কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দিকে যায়। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, ওই তিনটি ট্রেনের কোনও একটায় দেবাশিসবাবু ছিলেন।
বস্তুত বাড়ির লোকও এ সব নিয়ে বিস্তর ধন্দে। পরিবারের দাবি: শুক্রবার শিয়ালদহ থেকে মালবাজারের ট্রেন ধরার কথা ছিল দেবাশিসবাবুর। কেন তিনি পর দিন বর্ধমান থেকে ট্রেন ধরলেন, কেনই বা কোচবিহারের টিকিট কাটলেন, ওঁরাও তা ভেবে পাচ্ছেন না। শোভনবাবু এ দিন জানিয়েছেন, তাঁর শ্যালক শনিবার রাতে কাউকে কিছু না-বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “দেবাশিস বরাবরই রাত দশটার পরে মোবাইল বন্ধ করে দেয়। শনিবারও বন্ধ ছিল। বারোটার পরেও বাড়ি না-ফেরায় খোঁজ-খবর শুরু করি। তখনও ওর মোবাইল বন্ধ ছিল। রবিবার সকালে দুঃসংবাদ পেলাম।” দেবাশিসবাবুর ব্যাগ ও মোবাইলের অবশ্য সন্ধান মেলেনি। বারসই জিআরপি-র ওসি সন্তোষ কুমার জানিয়েছেন, মোবাইলের খোঁজ চলছে।
দেবাশিসবাবুর পরিবার নানা ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বাবা দুলাল দাস তৃণমূলের হয়ে জিতে মহেশতলা পুরসভার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। মা কস্তুরী দাস মহেশতলার তৃণমূল বিধায়ক। তাঁর নামেই মালবাজার পার্কের উল্টো দিকে ওঁদের হোটেলটির নামকরণ। তৃণমূল ও প্রশাসন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ সফরে এলে দেবাশিসবাবুদের তত্ত্বাবধানেই তাঁর জন্য গাড়ির বন্দোবস্ত করা হতো।