বছরভর বন্ধ ফ্ল্যাটে চিহ্ন নেই ধুলোর, বিস্মিত ইডি

সল্টলেকের এফডি ব্লকের হাজার দু’য়েক বর্গফুটের ফ্ল্যাটে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর (ইডি) অফিসারেরা। ঘর, ডাইনিং, স্নানঘরের সিলিং কোথাও এতটুকু ধুলো বা ঝুলের চিহ্ন নেই। চকচকে মেঝে দেখে বোঝার উপায় নেই, বছরভর ঝাঁট পড়েনি। তদন্তকারীদের এক জন তো বলেই ফেললেন, ‘আভি তক ইতনা সাফসুতরা!’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৫
Share:

সল্টলেকের বাড়িতে পিয়ালি সেন। বৃহস্পতিবার। ছবি: শৌভিক দে।

সল্টলেকের এফডি ব্লকের হাজার দু’য়েক বর্গফুটের ফ্ল্যাটে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর (ইডি) অফিসারেরা। ঘর, ডাইনিং, স্নানঘরের সিলিং কোথাও এতটুকু ধুলো বা ঝুলের চিহ্ন নেই। চকচকে মেঝে দেখে বোঝার উপায় নেই, বছরভর ঝাঁট পড়েনি। তদন্তকারীদের এক জন তো বলেই ফেললেন, ‘আভি তক ইতনা সাফসুতরা!’

Advertisement

কাশ্মীরে গ্রেফতার হওয়ার আগে একতলার এই ফ্ল্যাটেই দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন। ফ্ল্যাটটি বছর খানেক আগে ‘সিল’ করে দিয়েছিল বিধাননগর পুলিশ। কাগজে-কলমে তা ফের খোলা হল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায়। পিয়ালি সেনকে সঙ্গে নিয়ে।

ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ইমার্জেন্সি লাইট, টর্চ জ্বালিয়ে পিয়ালিকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলেন ইডি-র অফিসারেরা। বন্ধ জানলাগুলি নিজেরাই খুলে নিলেন একে একে। বাইরে থেকে আলো এসে পড়ল ফ্ল্যাটের ভিতরে। তখনই দেখা গেল, এক বছর বন্ধ থাকার পরও ধুলো-ময়লার কোনও চিহ্ন নেই ফ্ল্যাটে। চোখ কুঁচকে গেল তদন্তকারীদের। বন্ধ থাকা ফ্ল্যাট কী করে এতটা সাফসুতরো রয়েছে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন ওঁরা। এক জন ফের গিয়ে পরীক্ষা করলেন ফ্ল্যাটের মূল দরজা। দরজায় লাগানো রয়েছে একটি নামী সংস্থার ‘হ্যাচ’। এই হ্যাচের উপরে আঠা দিয়ে লাগানো ছিল বিধাননগর পুলিশের একটি কাগজ। ওই কাগজ লাগিয়ে ফ্ল্যাটটি ‘সিল’ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। ফ্ল্যাটের চাবি ছিল তাদের কাছেই।

Advertisement

ইডি সূত্রের খবর, এ দিন ওই কাগজ তুলে চাবি দিয়ে ‘হ্যাচ’ খুলে দেয় বিধাননগর পুলিশই।

কিন্তু ঘরদোর এত পরিষ্কার থাকল কী ভাবে? সরকারি ভাবে ‘সিল’ করা ফ্ল্যাটে কারও ঢোকা কি সম্ভব? বিধাননগর পুলিশের এক কর্তা দাবি করলেন, “এ রকম কোনও সম্ভাবনা নেই। ফ্ল্যাটের বাইরে সব সময় আমাদের পাহারা রয়েছে।” এ দিনও তল্লাশির সময়ে পাহারাদার পুলিশকর্মীদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে।

ফ্ল্যাটের ভিতরে তিনটি বড় শোওয়ার ঘর, তুলনায় ছোট আরও দু’টি ঘর। মস্ত ডাইনিং। পাঁচটি ঘরেই লাগানো রয়েছে বাতানুকূল যন্ত্র। ফ্ল্যাটের নানা প্রান্তে রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দের প্রমাণ সাইজের ছবি টাঙানো। রয়েছে তাঁদের ছোট-বড় মূর্তিও। দামি আসবাবে ঠাসা। স্নানঘর মোড়া দামি কাচে। সেখানে দামি কোম্পানির প্রসাধন। প্রতিটি ঘরে দেওয়াল-জোড়া দামি কাঠের আলমারি।

এর মধ্যে ইডি-র তল্লাশি দলের দু’জনকে দেখা গেল ফ্ল্যাটের পিছনের দিকে যেতে। সেখানে গিয়ে আরও এক বার চোখ কপালে তদন্তকারীদের। আস্ত পড়ে রয়েছে একটি টয়োটা গাড়ি। অন্য সব গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হলেও এটিকে নিয়ে যায়নি বিধাননগর পুলিশ। গাড়ি কী করে এখানে পড়ে থাকল, তা নিয়েও একপ্রস্ত আলোচনা করেন তদন্তকারীরা। গাড়িটি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি কেন? বিধাননগর পুলিশের একাংশ বলছেন, গাড়িটি সুদীপ্ত সেনেরই কি না, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। তবে এলাকার বাসিন্দারা দাবি করছেন, সুদীপ্তবাবুর ছেলেমেয়েরা ওই গাড়িতে চেপেই স্কুলে যেতেন। মূলত পরিবারের প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হত গাড়িটি।

এ দিন প্রায় চার ঘণ্টা ধরে ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালান তদন্তকারীরা। ইডি সূত্রের খবর, ফ্ল্যাটটিতে থাকা সব কাগজপত্রই পরীক্ষা করা হয়েছে। বাদ যায়নি ওষুধের প্রেসক্রিপশনও। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়েছে অনেক ফটো। ইডি-র দাবি, সুদীপ্ত ও পিয়ালির সঙ্গে যে সব রাজনৈতিক নেতার দহরম মহরমের অভিযোগ উঠছে, তাঁদের অনেকের ফটোও পারিবারিক অ্যালবামে মিলেছে। পিয়ালিকে ওই ফ্ল্যাটে বসিয়েই জানতে চাওয়া হয়েছে এর মধ্যে কাদের তিনি চেনেন, কী ভাবে চেনেন, তাঁদের সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের কত দিনের আলাপ, সুদীপ্ত সেনের ব্যবসার সঙ্গে তাঁরা জড়িত ছিলেন কি না ইত্যাদি।

প্রতিবেশীরা এ দিন জানান, সুদীপ্ত-পিয়ালি পাড়ায় বড় একটা মেলামেশা করতেন না। ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত পড়শিরা জানতেনই না, যাঁকে ধরা হয়েছে, তিনিই সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন। ইডি সূত্রের খবর, সল্টলেকেই অন্য একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন সুদীপ্তর ছেলে শুভজিৎ। সেই ফ্ল্যাটেও তল্লাশি চালানো হবে।

তবে ফ্ল্যাট এত সাফসুতরো কেন, বিস্ময় কাটছে না ইডি-র। তবে এখনই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি ইডি কর্তারা। ইতিমধ্যে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে পিয়ালি-সুদীপ্তর লকার নিয়ে ইডি-র সমালোচনার মুখে পড়েছে বিধাননগর পুলিশ। ইডি-র অভিযোগ, তারা লকারটি খুলতে গেলে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, লকারটি বিধাননগর পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। পরে বিধাননগর পুলিশ তড়িঘড়ি গিয়ে নিজেরাই লকারটি খুলে ফেলে। ইডি এই নিয়ে বিধাননগর পুলিশের বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন