বঞ্চনার আগুন ছাইচাপা ছিল শ্রমিক মহলেও

জুটমিলের চারটে গেটেই পুলিশের কড়া পাহারা। ভিড় বা জটলা তাই সেখানে নয়, ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে আশপাশের সাইকেল স্ট্যান্ড, চা-পান-বিড়ির দোকানে। এক-একটা গাড়ি দেখলেই এগিয়ে আসছে ভিড়, ‘‘কেউ এল না কি?” একটু পরেই জটলাটা পাতলা হয়ে যাচ্ছে সরকার বা মালিক পক্ষকে দেখতে না পাওয়ার হতাশা আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা নিয়ে। আর মাঝেমধ্যেই মুখগুলোতে ঠিকরে আসছে ক্ষোভ। ভদ্রেশ্বরের নর্থব্রুক জুটমিলের শ্রমিক-মহল সোমবার কাটাল এ ভাবেই।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

ভদ্রেশ্বর শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০৩:২৩
Share:

জুটমিলের চারটে গেটেই পুলিশের কড়া পাহারা। ভিড় বা জটলা তাই সেখানে নয়, ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে আশপাশের সাইকেল স্ট্যান্ড, চা-পান-বিড়ির দোকানে। এক-একটা গাড়ি দেখলেই এগিয়ে আসছে ভিড়, ‘‘কেউ এল না কি?” একটু পরেই জটলাটা পাতলা হয়ে যাচ্ছে সরকার বা মালিক পক্ষকে দেখতে না পাওয়ার হতাশা আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা নিয়ে।

Advertisement

আর মাঝেমধ্যেই মুখগুলোতে ঠিকরে আসছে ক্ষোভ। ভদ্রেশ্বরের নর্থব্রুক জুটমিলের শ্রমিক-মহল সোমবার কাটাল এ ভাবেই।

জুটমিলের স্থায়ী শ্রমিকদের অনেকে বলছেন, “এক কর্তা মারা গিয়েছেন বলে এখন দোষারোপ করা হচ্ছে। কই, আমরা যে বছরভর ঘরে জল পাই না, আলো বন্ধ করে দেওয়া হয় সে সব নিয়ে তো এত দিন কেউ কিছু বলেননি!” কিছু শ্রমিক ফুঁসে ওঠেন, “প্রতিদিন মাত্র ১৫৭ টাকা পাই। আপনারাই বলুন, তাতে কি সংসার চলে?”

Advertisement

রবিবার জুটমিলের সিইও হরিকিষান মহেশ্বরী-হত্যার নিন্দা করছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই। কিন্তু একই সঙ্গে তারা মনে করছে, শ্রমিকদের পিঠ যে ভাবে দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে, তাতে হিংসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েই ছিল। নর্থব্রুক-এর ঘটনাপ্রবাহ কেবল অনুঘটকের কাজ করেছে। চটকল কর্তৃপক্ষ ওই ঘটনায় ‘বহিরাগত দুষ্কৃতী’দের তত্ত্ব খাড়া করেছেন। এমনকী, শ্রমিকদের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’-এর দাবিও করেছেন। কিন্তু ওই চটকলের শ্রমিকদের অনেকের বক্তব্যেই সেই ‘সুসম্পর্ক’-এর ইঙ্গিত মিলছে না।

শ্রমিক মহলের অভিযোগ, প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা ঠিকমতো মেলে না। গ্র্যাচুইটি বকেয়া বছরের পর বছর। অন্য পাওনাও অনিয়মিত। এমনকী, আদালতের নির্দেশও অনেক সময়েই হাসি ফোটাতে পারে না তাঁদের মুখে। সার্বিক ভাবে অনেক দিন আগেই এ রাজ্যের চটকল-মালিকদের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন শ্রমিকেরা। সেই ক্ষোভ থেকে যে কোনও দিন, যে কোনও চটকলে হিংসা আরও বড় আকার নিতে পারে বলে অনুমান অনেকেরই। এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ আবার ধুঁকতে থাকা চটকল চালানোর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা মনে করছেন, গত বছর কেন্দ্র যে ভাবে রাজ্যের চটকলগুলির থেকে ৪০ শতাংশ বরাত কমিয়েছে, তাতে এই শিল্পে সরাসরি ধাক্কা লেগেছে। তেমনই আধুনিকীকরণ না হওয়ায় বিভিন্ন চটকল চলছে খুঁড়িয়ে। তার শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরাই।

শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে ‘আইনি সহায়তা কেন্দ্র’। ওই কেন্দ্রের হয়ে শ্রমিকদের প্রাপ্য আদায়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দৌড়েছেন আইনজীবী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই টাকা উদ্ধার করতে না পেরে তাঁর হতাশা, “দীর্ঘদিন বিভিন্ন চটকলে কাজ করে এখন চিকিৎসা করানোর টাকাও না পেয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন অনেক শ্রমিক। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার মুখে।” পরিস্থিতির জন্য সরকারি ব্যবস্থাকেই দায়ী করে বিশ্বজিৎবাবুর মত শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার হয় চটশিল্পের পুনরুজ্জীবনে গুরুত্ব দিক, না হলে চটকল বন্ধ করে দেওয়া হোক।

বাজার মন্দা এবং বরাত কম পাওয়ার কারণে নর্থব্রুক কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে এক বা দু’দিন ‘ডে-অফ’ চালু করার পরিকল্পনা করছিলেন। আর তা নিয়েই রবিবার শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে বৈঠক ছিল। ওই পরিকল্পনা কার্যকর হলে যে তাঁদের অবস্থার অবনতি হবে, সে আশঙ্কা শ্রমিকদের ছিল। তাই অফিসের বাইরে জড়ো হওয়া শ্রমিকেরা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। আর তার পরেই সিইও-হত্যার ঘটনা।

৪০ বছর কাজ করার পরে গত বছর মার্চ মাসে ওই চটকল থেকে অবসর নেন অজয় সেন। এখনও গ্র্যাচুইটির ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা পাননি। বিভিন্ন কারখানায় নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করে সংসার চালান। তাঁর কলেজ-পড়ুয়া মেয়ে মৌমিতা চটকল থেকে বাবার বকেয়ার জন্য দ্বারস্থ হয়েছেন ‘আইনি সহায়তা কেন্দ্র’-এর। ২০১০ সালে অবসর নেন ওই চটকলেরই আর এক শ্রমিক খোকন কুণ্ডু। তাঁর গ্র্যাচুইটির পাওনা ১ লক্ষ ২৪ হাজার টাকার মধ্যে দেড় বছর পরে পেয়েছেন ৯৯ হাজার টাকা। বারবার আবেদনেও বাকি টাকা না মেলায় দ্বারস্থ হয়েছেন আদালতের।

শুধু নর্থব্রুক নয়, রাজ্যের অন্য এলাকার চটকলের শ্রমিকদেরও হতাশা আর বঞ্চনার সুরটা একই রকম। গ্র্যাচুইটির টাকা না পাওয়ায় ইতিমধ্যেই চন্দননগরের গোন্দলপাড়া চটকলের অবসরপ্রাপ্ত ২২ জন শ্রমিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করেছেন। তাঁদের সাহায্য করার জন্য মালিকপক্ষ লোক লাগিয়ে হুমকি দিচ্ছে বলে থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন ‘আইনি সহায়তা কেন্দ্রে’র আহ্বায়ক গৌতম গুহরায়। ভদ্রেশ্বরের ভিক্টোরিয়া জুটমিলের অবসরপ্রাপ্ত অন্তত দু’হাজার শ্রমিকের গ্র্যাচুইটির টাকা বকেয়া রয়েছে সেই ২০০৬ সাল থেকে। ওখানকারই ডালহৌসি চটকলের শ্রমিকদের অভিযোগ, তাঁদের বকেয়া অর্ধেক করে মেটানো হয়। সোমবারই প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে সেখানকার অবসরপ্রাপ্ত এক শ্রমিককে তাঁর বকেয়া ৭৪ হাজার টাকা সুদসমেত মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।

রিষড়া থেকে শুরু করে বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত হুগলি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে মোট ১৪টি চটকল। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে যার সঙ্গে অন্তত ১ লক্ষ ২০ হাজার শ্রমিক জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থাকায় তাঁদের হতাশা যে সঙ্গত, তা মেনে নিয়েছেন শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। রাজীব গাঁধীর আমলে এ রাজ্যের চটশিল্পকে বাঁচানোর জন্য যে ১১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা সে ভাবে কাজে লাগানো যায়নি বলে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, “সত্যিই চটকল শ্রমিকেরা সার্বিক ভাবে বঞ্চনার শিকার। বস্তা তৈরি বাদে চটশিল্পের বাণিজ্যিকীকরণের জন্য কিছু করা হয়নি। রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারকে দোষ দেব না। স্বীকৃত বাম-ডান শ্রমিক সংগঠনগুলিও দায়িত্ব পালন করেনি। গত এপ্রিল মাস থেকে চটকলগুলি কেন্দ্রের কাছ থেকে বরাত পাচ্ছে না।” কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়া সমস্যা মেটার নয় বলে তিনি জানান। সিটু, আইএনটিইউসি-র মতো শ্রমিক সংগঠনগুলিও এই শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মিলিত উদ্যোগ চাইছে।

রাজ্য বা কেন্দ্র বা শ্রমিক সংগঠনেরা কবে, কী করবে সে সব নিয়ে অবশ্য এখন মাথা ঘামাচ্ছে না নর্থব্রুক-এর শ্রমিক মহল। কয়েক জন ঠিক করে ফেলেছেন, অন্য চটকলে বদলিতে কাজ করবেন। যাঁদের এখনও সে জোগাড় হয়নি, তাঁদের কপালের ভাঁজ ক্রমশ গভীর হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন