এ রাজ্যের রাজনীতিতে এ বারই প্রথম। তার হয়ে প্রচার করার জন্য নামেননি বড় মাপের নেতা-তারকা। এমনকী একখানা প্রতীকও জোটেনি। ফল বেরোতে দেখা গেল, বহু কেন্দ্রে সে প্রথম পাঁচজনের একজন। বাঁকুড়ায় পিছনে ফেলে দিয়েছে কংগ্রেসকে। মথুরাপুরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দিয়েছে এসইউসিআই প্রার্থীকে। রায়গঞ্জে কংগ্রেসের পরাজয়েও তার ভূমিকা কম নয়।
এ রাজ্যে এমনই সাড়া জাগিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ইভিএম বাক্সের ‘নোটা’। মুখে মুখে যা ‘না-বোতাম।’ কোনও দলের প্রার্থীকে পছন্দ না হলে তা বোঝানোর জন্য এ বার লোকসভা ভোটে ‘নান অব দ্য অ্যাবাভ,’ সংক্ষেপে ‘নোটা’ বোতাম কমিশন যোগ করেছে। নয়া এই ধারণা রাজ্যবাসী কতটা গ্রহণ করবেন, তা নিয়ে ধন্দ ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক মেরুকরণের রাজ্যে ‘না’ বোতাম টিপে ভোটদাতারা নিজের ভোটটা ‘নষ্ট’ করবেন কিনা, সে প্রশ্নও উঠছিল।
ফল বেরোতে স্পষ্ট হল, ‘নোটা’ বোতাম টিপেছেন যাঁরা, তাঁদের সংখ্যাটা খুব কম নয়। গোটা রাজ্যে ৫ লক্ষ ৮৩ হাজার। প্রতি আসনে গড়ে ১৩,৮৮৮। আরামবাগ, বালুরঘাট, বনগাঁ, বীরভূম, বোলপুর, দমদম, কলকাতার দুটি আসন-সহ বেশ কিছু আসনে বড় চারটি দলের প্রার্থীর পরেই ভোট পেয়েছে ‘নোটা।’ দু-এক জায়গায় প্রথম পাঁচের বাইরে ঠেলে দিয়েছেন খানিক জোরদার প্রার্থীরা, যেমন বসিরহাটে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, বা দার্জিলিঙে মহেন্দ্র লামা। মথুরাপুরে বেশ কিছুক্ষণ এসইউসিআই প্রার্থী পূর্ণচন্দ্র নাইঞাকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল ‘নোটা’। পরে ৮৭৪ ভোটে শেষরক্ষা হয় পূর্ণবাবুর। পুরুলিয়াতে অবশ্য হাজার পাঁচেক ভোটে এসইউসিআইয়ের সুবর্ণ বণিককে পিছনে ফেলেছে ‘নোটা।’ কিন্তু সমাজবাদী পার্টি, বিএসপি, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা, ঝাড়খন্ড দিশম পার্টির মতো ছোট দলগুলোকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে। আম আদমি পার্টি তো ধারেকাছেই আসতে পারেনি।
দেশ জুড়ে না-ভোটে মত দিয়েছেন ১.১% ভোটার, যার অর্থ, ৬০ লক্ষের বেশি মানুষ। সব চেয়ে বেশি না-ভোট পড়েছে পুদুচেরিতে, তার পর মেঘালয়ে। নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতে না-ভোট পড়েছে ১.৮%। দেশজুড়ে তাঁকে নিয়ে যতই মাতামাতি হোক, মোদীর নিজের ভোটকেন্দ্র বডোদরায় কোনও প্রার্থীকেই না-পসন্দ করেন ১৮,০৫৩জন।
কী বলছেন এ রাজ্যের বড় দলগুলির নেতারা? জঙ্গলমহলে তৃণমূলের এক বিধায়ক প্রশ্ন তুলেছেন, রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের না-পসন্দ, নাকি ভোটই না-পসন্দ ‘নোটা’-প্রেমীদের? অন্য জেলায় যেখানে নোটার গড় ১৩ হাজার, সেখানে বাঁকুড়াতে ২৩ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে ‘নোটা’ এসেছে চতুর্থ স্থানে। প্রায় হাজার ভোটে পিছিয়ে কংগ্রেস প্রার্থী নীলমাধব গুপ্ত। ঝাড়গ্রামে প্রায় ২৩ হাজার ভোট টেনেছে ‘নোটা’। মাওবাদী প্রভাব না থাকলে এটা সম্ভব নয়, বলেন তিনি। তৃণমূলের অনেকের ইঙ্গিত, কলকাতা দক্ষিণ (১৯,৫০৪) বা যাদবপুরে (১৫,৬৬৭) যে কলকাতা উত্তরের প্রায় দ্বিগুণ ভোট পড়েছে না-বোতামে, তা-ও এই সব এলাকায় অতিবামদের প্রভাব রয়েছে বলে।
জঙ্গলমহলের সব প্রার্থী অবশ্য এই ব্যাখ্যা মানছেন না। সাড়ে তিন হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন ঝাড়খন্ড অনুশীলন পার্টির মুরারীমোহন বাস্কে। তাঁর বক্তব্য, “বড় চার দলের প্রার্থীকে পছন্দ না হলেই নোটায় ভোট দিচ্ছেন সকলে। তাই আমরা ওই ভোটটা পাচ্ছি না।” বড় দলের নেতারাও নোটা নিয়ে অখুশি। প্রদেশ যুব তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি তথা জলপাইগুড়ি জেলার পর্যবেক্ষক সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “মনে হচ্ছে, অনেকে ‘নোটা’-কে প্রার্থী ভেবে ভুল করে ভোট দিয়েছে।” উত্তরবঙ্গের ছ’টি জেলা মিলিয়ে ৯০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছে নোটা। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী, বামনেতা অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “এত ভোট নোটা-তে পড়েছে দেখে সত্যিই অবাক লাগছে।”
নোটার ভোটের মাহাত্ম্য কতটা, তা টের পেয়েছেন গত বছরের বিধানসভা ভোটে চার রাজ্যের প্রার্থীরা। ছত্তীশগঢ়ের অন্তত ১৫টি কেন্দ্রে যত ভোটে হেরেছেন জয়ী প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, তার চাইতে বেশি ভোট পড়েছে ‘নোটা’য়। তখন থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নোটাকে।
সে চ্যালেঞ্জ কত কঠিন, পশ্চিমবঙ্গে বুঝছেন দীপা দাশমুন্সি। রায়গঞ্জে প্রায় ১১ হাজার ভোট পড়েছে ‘নোটা’তে। তা থেকে মাত্র হাজার দেড়েক পেলেই বামপ্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে হারিয়ে দিতে পারতেন দীপা।