হোটেলের ঘরে হঠাৎ বিপর্যয়

বড়সড় বিপদ থেকে রক্ষা মমতার

বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী এখন নির্বাচনী প্রচারে রয়েছেন মালদহে। সেখানে তিনি একটি বেসরকারি হোটেলে উঠেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রচার সেরে ওই হোটেলে ফিরে আসেন। তিনি যে ঘরে থাকছেন, সেখানকার এসি মেশিন হঠাৎ ফেটে গিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে যায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘর। আলো নিভে যায়। সন্ধে তখন সাড়ে ছ’টা। মুখ্যমন্ত্রী স্নান করছিলেন। কোনও রকমে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি রক্ষা পান বলে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র জানিয়েছেন। ওই হোটেলেরই অন্য ঘরে ছিলেন মদনবাবু। আতঙ্কিত মমতা নিজে পরে একটাই কথা বলেন, “এটা খুব বড় ঘটনা।”

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৯
Share:

তখনও মালদহ উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সৌমিত্র রায়ের সমর্থনে হবিবপুরের আমবাগানে বক্তৃতা দিচ্ছেন।

বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী এখন নির্বাচনী প্রচারে রয়েছেন মালদহে। সেখানে তিনি একটি বেসরকারি হোটেলে উঠেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রচার সেরে ওই হোটেলে ফিরে আসেন। তিনি যে ঘরে থাকছেন, সেখানকার এসি মেশিন হঠাৎ ফেটে গিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে যায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘর। আলো নিভে যায়। সন্ধে তখন সাড়ে ছ’টা। মুখ্যমন্ত্রী স্নান করছিলেন। কোনও রকমে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি রক্ষা পান বলে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র জানিয়েছেন। ওই হোটেলেরই অন্য ঘরে ছিলেন মদনবাবু। আতঙ্কিত মমতা নিজে পরে একটাই কথা বলেন, “এটা খুব বড় ঘটনা।”

এমন ঘটল কী করে? পুলিশ এবং দমকলের অনুমান, শর্ট সার্কিটের ফলেই এসি মেশিনটি ফেটে বিপত্তি ঘটিয়েছে। তবে তৃণমূলের অভিযোগ, ঘটনাটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এখন রাজ্যের পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নির্বাচন কমিশনের হাতে। কমিশনই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ তৃণমূলের। মদনবাবু বলেন, “পুরো ঘটনাটি মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ঈশ্বরের কৃপায় তিনি বেঁচে গিয়েছেন।” ঘটনার কথা দিল্লিতে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে জানানো হয়। তিনি রাতেই নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পতকে চিঠি লিখেছেন।

Advertisement

চিঠিতে মুকুলবাবু অভিযোগ করেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর জেড প্লাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এখন আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোটাই নির্বাচন কমিশনের অধীনে। স্বভাবতই কমিশন মুখ্যমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।” চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, “এই ঘটনার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর ভয়াবহ পরিণতি ও প্রভাব এ রাজ্য-সহ সারা দেশে পড়তে পারত।” কমিশনের এক কর্তা বলেন, “বিষয়টি জেনেছি। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।”

প্রাথমিক তদন্তে ঘটনাস্থলে গিয়ে মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ঘটনার পিছনে প্রযুক্তিগত ত্রুটি রয়েছে। আমরা বিস্তারিত খতিয়ে দেখছি।” হোটেলের কর্ণধার দিলীপ অগ্রবাল দাবি করেছেন, “শর্ট সার্কিটে এসি মেশিনে বিভ্রাটের দরুণ সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রীকে পাশের ঘরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছি।” তিনি জানান, গত মঙ্গলবার থেকে হোটেলের ওই ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রুমে’ই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

জনসভা সেরে হোটেলের এই ঘরেই উঠেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

শর্ট সার্কিট হল কেন? জেলা বিদ্যুৎ দফতরের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার শৈবাল মজুমদার অবশ্য দায় হোটেল কর্তৃপক্ষের উপরেই চাপিয়েছেন। তাঁর দাবি, এতে বিদ্যুৎ দফতরের কোনও দোষ নেই। হোটেলের সার্কিটে সমস্যা থাকাতেই এমন ঘটেছে। শৈবালবাবুর কথায়, ‘‘আমরা হোটেলকে বাল্ক কানেকশন নিতে বলেছিলাম। ওরা তা নেয়নি। সংযোগের ত্রুটি থেকেই সমস্যা হয়েছে।”

এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিরোধী শিবিরের নেতারাও। তৃণমূল চক্রান্তের ইঙ্গিত করলেও তা নিয়ে এ দিন অন্তত পাল্টা কোনও আক্রমণে যেতে চায়নি বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু যেমন উদ্বেগ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন, তেমনই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করেছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় একই ভাবে পার্থবাবুর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “আমরা চাই, মুখ্যমন্ত্রী সুস্থ থাকুন। তবে সব কিছুতে চক্রান্ত থাকতে হবে, এর কী মানে আছে?” প্রচারের কাজে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীও এই মুহূর্তে মালদহে। তিনি বলেন, “এমন ঘটনায় উদ্বিগ্ন। কী ঘটেছিল, তদন্ত করে দেখা দরকার।”

রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা ইতিমধ্যেই উচ্চপর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। নবান্ন সূত্রে খবর, স্থানীয় থানায় এফআইআর দায়ের করে পরবর্তী সময়ে তদন্তভার সিআইডিকে দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। পুরো ঘটনা তদারকির জন্য মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। ডিরেক্টর সিকিউরিটি বীরেন্দ্রকে বলা হয়, প্রতি ঘণ্টায় রাজ্য প্রশাসনকে রিপোর্ট পাঠাতে। রাতে ওই হোটেলেই থাকেন মুখ্যমন্ত্রী।

রাজ্য দমকলের ডিজি (ডিপি) তারানিয়া বলেন, “দমকলের ডিভিশনাল অফিসার অভিযোগ দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছেন। পুলিশও পৃথক ভাবে তদন্ত করছে। এসি লাইন থেকেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। ওই হোটেলের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা কেমন ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

হোটেলের কর্মীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, এ দিন দুপুর তিনটে নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বণ্টন নিগমের তরফে হোটেলের ৬৩ কেভি-র ট্রান্সফর্মার বদলে ১০০ কেভি-র ট্রান্সফর্মার লাগানো হয়। তার পর থেকেই ভোল্টেজ ওঠানামা করছিল। তার ফলেই শর্ট সার্কিট হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। মদনবাবুও বলেন, “যখন তিনতলা থেকে দোতলায় নামছিলাম, তখন হোটেলের আলো দপদপ করছিল।”

এ দিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ হবিবপুর, মালতীপুর এবং হরিশ্চন্দ্রপুরে প্রচার সেরে হোটেলে ফেরেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিন তলার একটি ঘরে মদনবাবু, মিঠুন চক্রবর্তী-সহ আরও কয়েক জনের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মদনবাবু জানিয়েছেন, বৈঠক শেষ হলে সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী ‘একটু স্নান, পুজো সেরে আসছি’ বলে দোতলায় নিজের ঘরে যান।

মদন বলেন, “এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই রাজ্য পরিবহণ দফতরের ওএসডি জয়ন্ত সাহা দৌড়তে দৌড়তে এসে জানান, মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে আগুন লেগেছে। আমরা দৌড়ে যাই। দেখি মুখ্যমন্ত্রীর ঘর ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে।” পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “আমরা গিয়ে দেখি, মুখ্যমন্ত্রীর ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোনও রকমে একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে দিদি থরথর করে কাঁপছেন। মুখে কোনও কথা নেই। স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না।”

মদনবাবু জানান, ধোঁয়ায় ভর্তি ঘর থেকে একটা কটু গন্ধ বেরোচ্ছিল। “পরে দমকলের কাছ থেকে জানতে পারি, সেটি হিলিয়াম গ্যাসের গন্ধ। এসি মেশিনের মধ্যে থাকে।” ঘটনার দেড় ঘণ্টা পরেও ওই গন্ধ ঘর থেকে পুরোপুরি যায়নি। তাঁর কথায়, একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি যখন বাথরুমে স্নান করছিলেন, সে সময়ে জোরে একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ হয়। তার পরেই সব অন্ধকার হয়ে যায়।

পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “দিদি সবাইকে জানান, ‘বাথরুমে ভাগ্যিস ছিটকিনি লাগানো ছিল না। শুধু ল্যাচ ছিল। না হলে আমি হয়তো অন্ধকারে বাথরুম থেকে বেরোতেই পারতাম না! বাথরুম থেকেই ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার করতে থাকি। সেই সময় কাছেই ছিলেন জয়দীপ (জয়দীপ দাস, মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহায়ক)। ও আমার আঁকার সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখছিল। আমার চিৎকার শুনে ঘরের মধ্যে দৌড়ে আসে। আমার দিকে একটি চাদর এগিয়ে দেয়।”

পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা দেখে গিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানান, ভালই আছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

“মুখ্যমন্ত্রীর জেড প্লাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।
এখন আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোটাই নির্বাচন কমিশনের
অধীনে।স্বভাবতই কমিশন মুখ্যমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে
ব্যর্থ।এই ঘটনার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা
উড়িয়ে দেওয়া যায় না।” —মুকুল রায়

মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে লেখা চিঠি।

ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন