তারা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী নয়। ভাড়াটেও নয়। বর্ধমানে বাদশাহি রোডেই তাদের চোদ্দো বছরের বাস।
তবু সেই রেজাউল শেখ এবং তার পরিবারের জন্যই গোটা তল্লাটে সতর্কতার বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এত দিন যে বাড়িওয়ালারা বিশ্বাসের বশে ভাড়াটেদের থাকতে দিয়েছেন, তাঁরাই এখন পরিচয়পত্র দেখতে চাইছেন। অন্তত চার-পাঁচটা বাড়ি থেকে ভাড়াটেদের উঠে যেতে বলা হয়েছে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মালিকদের বলছেন, ভাল করে কাগজপত্র না দেখে নতুন করে ভাড়া দেবেন না।
আতঙ্কটা অমূলক নয়। কারণ, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে হত শাকিল আহমেদ, জখম আব্দুল হাকিম, ধরা পড়া রাজিয়া বা আলিমা বিবিদের কেউই বর্ধমানের আদি বাসিন্দা নয়। রেজাউলের পরিবারও মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থেকে এসেছিল। বছর দেড়েক আগে তারা এই একতলা বাড়িটি করে। তার আগে কাছেই কাকা খাবিরুদ্দিনের বাড়িতে তারা থাকত।
স্থানীয় সূত্রের খবর, রেজাউলের বাবা মন্টু শেখ চোদ্দো বছর আগে রঘুনাথগঞ্জের খোদারামপুর পঞ্চায়েত এলাকার ভূতবাগান থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে বর্ধমানে এলেও স্ত্রী বা মেয়েদের আনেননি। বছর সাতেক আগে রেজাউলও রাজমিস্ত্রির কাজ করতেই আসে। এই বাড়ির আর একটি অংশে বাবা-ছেলে ছাড়াও মন্টুর দাদা চমক শেখ পরিবার নিয়ে থাকত। ঘটনার পর থেকে তারাও বেপাত্তা।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, বিস্ফোরণে হত শাকিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল রেজাউলের। ঘটনায় রেজাউলের নাম জড়ানোয় এবং পরিবারের অনেকের সঙ্গে সে উধাও হয়ে যাওয়ায় পাড়ার লোকজন কার্যত হতচকিত। এনএসজি এসে শৌচাগারে চাটাই দিয়ে তৈরি ফল্স সিলিং থেকে ৩৫টি আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পাওয়ার আগে পুলিশ যে ভাবে রেজাউলদের বাড়িটি স্রেফ তালা মেরে রেখে দিয়েছিল, তাতে পুলিশের উপরেও তাঁদের আস্থা উবে গিয়েছে। কেন না, বাড়িটিতে ঢোকার সদর দরজায় তালা মারা হলেও তার ফুট তিনেক উপরে বড় একটি চৌকো গর্ত রয়েছে, যা দিয়ে যে কোনও পূর্ণবয়স্ক লোক অনায়াসে ভিতরে ঢুকতে বা বেরোতে পারে। ছাদের সিঁড়ির মুখেও কোনও দরজা নেই, পাঁচিলে পা দিয়ে সেই ছাদে উঠে পড়াটাও কঠিন কিছু নয়।
অর্থাৎ, গত ৭ অক্টোবর রাতে পুলিশ তালা লাগিয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে বৃহস্পতিবার এনএসজি আসা পর্যন্তন’দিন বিস্ফোরকগুলি অরক্ষিতই পড়ে ছিল। কেউ চাইলে দরজার তালা না ভেঙেও সেগুলি অনায়াসে বার করে নিয়ে যেতে পারত। এমন একটি বাড়ি পুলিশ এবং সিআইডি কী ভাবে এতটা অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখল, আইইডি পাওয়ার পরে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন এনএসজি কম্যান্ডোরাও। শৌচাগারে কেন ফল্স সিলিং থাকবে, এই প্রশ্নটা কেন রাজ্যের গোয়েন্দাদের মাথায় এল না, এলাকার মানুষই এখন সেই প্রশ্ন তুলছেন।
যদিও জেলা পুলিশ এবং সিআইডি এখন পরস্পরের কোর্টে বল ঠেলতে ব্যস্ত। বৃহস্পতিবারই জেলার এক পুলিশ-কর্তা বলেছিলেন, “আগে যখন তল্লাশি হয়, তদন্তভার সিআইডি-র হাতে ছিল।” এ দিন সিআইডি-র এক কর্তা আবার দাবি করেন, “আমরা ওখানে যাইনি। তাই কিছু খেয়াল করারও প্রশ্ন নেই।”
এ দিন সকালে বর্ধমান সদরঘাটে দামোদরের চরে বিস্ফোরকগুলি ফাটিয়ে দেওয়া হয়। পরে তালা ভেঙে ফের ওই বাড়িতে তল্লাশি চালায় এনএসজি এবং এনআইএ (জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা)। কিছু নথি ও নমুনাও সংগ্রহ করে তারা। কিন্তু তাতে বাদশাহি রোডে স্বস্তি ফেরেনি। বরং যদি খাগড়াগড়ের মতো এখানেও বিস্ফোরণ ঘটত, তা হলে কী হত তা ভাবতেই শিউরে উঠছেন এলাকার মানুষ। সেই সূত্রেই সকাল থেকে ভাড়াটেদের পরিচয় নিয়ে খোঁজখবর শুরু হয়েছে।
পাড়ার ক্লাবের সদস্য মির বাবু, দোলন মণ্ডলেরা বলেন, “আমরা সমস্ত বাড়িতেই যাচ্ছি। অপরিচিত বাসিন্দাদের কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে রাখছি, যাতে এর পরে কোনও ঘটনা ঘটলেই পুলিশকে সাহায্য করতে পারি।” কাগজপত্র ঠিক নেই বা আচরণ সম্পর্কে তাঁদের সন্দেহ রয়েছে, এমন চার-পাঁচটি পরিবারকে বাড়ি ছাড়তে ‘অনুরোধ’ও করেছেন তাঁরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বাড়ির মালিক বলেন, “পাড়ার ছেলেরা এসে জানতে চাইছিল, ভাড়াটের পরিচয়পত্র রেখেছি কি না। ও সব কোনও দিনই রাখিনি। তাই ভাড়াটের কাছেও গিয়েছিল ওরা। তাদের পরিচয়পত্র নেই জানার পরে এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার জন্য অনুরোধ করে গিয়েছে।”
এখন স্মৃতি হাতড়ে রেজাউলের আচার-ব্যবহারে অসঙ্গতিও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। তাঁরা জানান, সে পাড়ার কারও সঙ্গে মিশত না। তবে মাঝে-মধ্যে মাঝরাতে তাকে বাড়ির ছাদে তিন-চার জনের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যেত। তারা এই এলাকার লোক নয়। কিন্তু তা বলে সে সময়ে খারাপ কিছু সন্দেহও করেননি কেউ। পড়শি সরিফুল বিবির কথায়, “বাবা-ছেলে সকালে কাজে যেত, দেখতাম। রেজাউল যে এমন কিছুতে জড়াতে পারে, ভাবতেই অবাক লাগছে।” স্থানীয় ইমাম আজিজুল মল্লিক বলেন, “এটা তো চরম নিন্দনীয় ঘটনা।”
রেজাউলদের থেকে নিজেদের তফাত করছেন আত্মীয়েরাও। রেজাউলের কাকিমা, খাবিরুদ্দিনের স্ত্রী মিনু বিবি বলেন, “আমাদের সঙ্গে অনেক দিন ওদের সম্পর্ক নেই। যে যেমন কর্ম করেছে, তেমনই ফল ভোগ করবে!”