পাড়ুই কাণ্ড

মুখ্যমন্ত্রীও তো মহিলা, তা হলে মার খেলাম কেন

মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শাসনে নিরাপদ নন মহিলারাই, এমনই অভিযোগ তুললেন পাড়ুইয়ের নির্যাতিতা বধূ! শনিবার সন্ধ্যায় তাঁকে যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সামনে পড়তে হয়েছে, সে আতঙ্ক এখনও কাটেনি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই বধূর। সোমবার হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে বছর বাইশের ওই তরুণী প্রশ্ন তুললেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তো মহিলা। শুনেছি পুলিশ দফতরও তাঁর হাতেই রয়েছে। তার পরেও এক মহিলাকে এ ভাবে মারা হল কেন?”

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৫
Share:

হাসপাতালে নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করল রাজ্য মহিলা কমিশন

মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শাসনে নিরাপদ নন মহিলারাই, এমনই অভিযোগ তুললেন পাড়ুইয়ের নির্যাতিতা বধূ!

Advertisement

শনিবার সন্ধ্যায় তাঁকে যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সামনে পড়তে হয়েছে, সে আতঙ্ক এখনও কাটেনি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই বধূর। সোমবার হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে বছর বাইশের ওই তরুণী প্রশ্ন তুললেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তো মহিলা। শুনেছি পুলিশ দফতরও তাঁর হাতেই রয়েছে। তার পরেও এক মহিলাকে এ ভাবে মারা হল কেন?”

এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি পুলিশ-প্রশাসনের কাছ থেকে। তবে, বিজেপির দাবি, ওই মহিলার শ্বশুরবাড়ি তাদের সমর্থক হওয়ায় শাসকদল তৃণমূল এবং পুলিশ মিলে ওই বধূর উপরে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। এই সূত্রেই মুখ্যমন্ত্রীকে বিঁধে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রশ্ন, “মুখ্যমন্ত্রী কি গান্ধারী সেজে বসে আছেন? নাকি তিনি মেয়েদের উপরে এই ধরনের আক্রমণ সমর্থন করছেন?”

Advertisement

রবিবার ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই তোলপাড় হয়েছে রাজ্য রাজনীতি। নিন্দায় মুখর হয়েছে বিরোধী দলগুলি। এ দিন অবধি অবশ্য নির্যাতিতা কিংবা তাঁর পরিবারের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেখা যায়নি শাসক দলের কাউকেই। তবে, এ দিন সকালেই রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বর্ধমান মেডিক্যালে পৌঁছে যায় কমিশনের এক প্রতিনিধিদল। তাতে ছিলেন শাসকদল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ও। আর ছিলেন শিখা আদিত্য।

কমিশনের প্রতিনিধিরা জরুরি বিভাগে গিয়ে ওই মহিলার সঙ্গে আধ ঘণ্টা একান্তে কথা বলেন। পরে সুনন্দাদেবী বলেন, “মহিলা আমাদের জানিয়েছেন, পুলিশ তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন করেছে। মহিলা হিসেবে আমরা ওই ঘটনার নিন্দা করছি। আমরা ওঁর পাশে রয়েছি।” তাঁর দাবি, “এই ঘটনায় কোনও রাজনৈতিক রং দেখা উচিত হবে না। এক জন মহিলা নির্যাতিতা হয়েছেন, সেটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা। রাজ্য সরকারকে ওই ঘটনার কথা জানাব। কমিশনের নিন্দার কথাও জানাব।” নির্যাতিতার পরিবারের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ যে মামলা রুজু করেছে, তার তদন্ত যাতে আদালতের তত্ত্বাবধানে হয়, সেই সুপারিশও কমিশন করবে বলে চেয়ারপার্সন আশ্বাস দিয়েছেন। লকেটও বলেন, “মহিলার আইনি সাহায্য পাওয়া দরকার। সুচিকিৎসাও মেলা দরকার। সে সব যাতে তিনি পান, তার দিকে কমিশন নজর রাখবে।”

এ দিনও বারবারই পুলিশি অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন নির্যাতিতা। তিনি দাবি করেন, “দীর্ঘদিন ধরে পাড়ুই এলাকায় পুলিশ অত্যাচার করছে। পাড়ুইয়ে থেকে তৃণমূল করেন না এমন মহিলাদের শরীর যদি নিরপেক্ষ কোনও মহিলাকে দেখানো হয়, তা হলে তিনি দেখতে পাবেন প্রত্যেক মেয়ের গায়ে কী রকম পুলিশের লাঠির দাগ!” এর পরেই তাঁর প্রশ্ন, “আমি তো অপরাধী নই। তা হলে পুলিশ আমার উপর অত্যাচার করল কেন? সেই রাতে যে ভাবে আমাকে গাছে বেধে মারধর করছিল, তাতে আমি চিৎকার না করলে হয়তো মেরেই ফেলত!”

ওই ঘটনাকে হাতিয়ার করে এ দিন থেকে তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে বিরোধী দলগুলির মধ্যেও। কমিশনের পরেই নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করেন বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার, বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যরা। সুভাষবাবু বধূর চিকিৎসায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করেন। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার অসিতবরণ সামন্ত অবশ্য সে অভিযোগ মানেননি। এ দিন হাসপাতালে নির্যাতিতাকে দেখতে গিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রীরাও। সিউড়িতে আবার প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী।

এ দিনই পাড়ুইয়ের সাত্তোরে বধূর শ্বশুরবাড়িতে যায় বিজেপির একটি প্রতিনিধিদল। যে দলে ছিলেন শমীকবাবু ও সুভাষবাবু। শমীকবাবু অভিযোগ করেন, “পুলিশ তৃণমূলের ‘ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন’ হিসেবে কাজ করছে। এত দিন আমরা রাজনৈতিক দলের আশ্রিত সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতাম। এখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশই তাদের কাজটা

করে দিচ্ছে!” এর পরেই আক্রান্ত পরিবারের এক স্কুলছাত্রীকে নিয়ে সিউড়িতে গিয়ে বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার সঙ্গে দেখা করেন শমীকবাবুরা। বিজেপির অভিযোগ, পুলিশের জুলুমের জেরে মেয়েটি একমাস ধরে স্কুল যেতে পারছে না। এসপি অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

পাড়ুইয়ে যখন সুভাষবাবুরা পুলিশ আর শাসকদলের বিরুদ্ধে আক্রমণের ধার তীব্র করছিলেন, কলকাতায় তখন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের নেতৃত্বে অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়-সহ কয়েক জন দলীয় প্রতিনিধি পৌঁছে গিয়েছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে। সেখান থেকে বেরিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে নির্যাতিতার জন্য ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন রাহুল। ঘটনার কথা জাতীয় মহিলা কমিশনের কানে তোলার কথাও ঘোষণা করেন। পরে রূপা বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁরা তা ভুলে যাচ্ছেন। মানুষ সব দেখছেন। এক জন মহিলাকে নিয়ে যাওয়া হল। থানায় যাওয়ার কথা। অথচ নিয়ে যাওয়া হল জঙ্গলে! মুখ্যমন্ত্রী কি এর মধ্যে তাঁর কোনও দোষ দেখতে পাবেন?”

এরই পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটা ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসার ২৪ ঘণ্টা পরেও এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীরবতা এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতার না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। ওই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর কড়া হস্তক্ষেপ দাবি করে রাহুল বলেন, “ভাবতে অবাক লাগে, মুখ্যমন্ত্রী এক জন মহিলা! পুলিশমন্ত্রীও তিনিই! তা সত্ত্বেও রাজ্যে মহিলারা আক্রান্ত! এই সরকারকে নারী নির্যাতনকারী সরকার আখ্যা দেওয়া উচিত।” ঘটনার প্রতিবাদে এ দিনই কলেজ স্কোয়্যারে বিজেপির মহিলা মোর্চা বিক্ষোভ দেখায়। মৌলালিতে বিক্ষোভ দেখায় গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি।

বিরোধীদের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “বিরোধীদের যদি কিছু বলার থাকে, তা হলে আমাদের কাছে সরাসরি কেন বলছেন না? বিরোধীদের কথা তো আমরা শুনি। বিরোধীরা কী চাইছেন, তা সংবাদমাধ্যমকে বলে লাভ কী?”

হাসপাতালে শুয়ে নির্যাতিতা কিন্তু জানতে চাইছেন, “বিরোধী দলনেত্রী থাকার সময় মুখ্যমন্ত্রীকেও তো পুলিশ অত্যাচার করেছিল। সেই মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে আমাদের উপরে এমনটা কেন হবে?” তার অবশ্য জবাব মিলছে না।

এক বিরোধী নেতার কটাক্ষ, “তখনকার বিরোধী আজ যে শাসক!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন